৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন - ফাইল ছবি

পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমরনীতি বহুলাংশে আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ওয়ারশ জোট গঠন করে পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবমুক্ত নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিল।

ওয়ারশ জোট বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে সে স্বপ্নের অবসান ঘটেছে। বর্তমানে বিশ্বে চীন উদীয়মান মহাশক্তি হিসেবে প্রভাববলয় বিস্তারে সদা সচেষ্ট। এ দিকে আমেরিকা দীর্ঘ দিন যাবত বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখার লক্ষ্যে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বা পররাষ্ট্রনীতি সাধারণত একই ধারায় প্রবাহিত হয়। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সমর্থিত। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ট্রাম্প ও বাইডেন অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির দিকনির্দেশনা জাতির সামনে উপস্থাপনা করেছিলেন। এ দুই দলের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মৌলিক কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। তবে এ কথা সত্য যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে প্রধানত দু’টি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তিনি দেশের অভিবাসননীতি সঙ্কোচন করেছিলেন। ফলে বহিরাগত আগমন হ্রাস পাওয়ায় দেশের শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের পথ প্রসারিত হয়েছিল।

অপর দিকে তিনি ন্যাটো জোটে আমেরিকার দেয়া অতিরিক্ত চাঁদার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছিলেন। তদুপরি আমরা জানি, আমেরিকা তার পররাষ্ট্রনীতিকে শক্তিশালী ও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য বিদেশে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার সেনা ও যুদ্ধসরঞ্জাম পাঠিয়েছিল। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়াসহ অনেকে দেশে যুদ্ধের নতুন নতুন ফ্রন্ট খুলেছিল। এসব ফ্রন্টের জন্য আমেরিকার প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হতো। অনেক সেনার জীবনহানি ঘটতো। আমেরিকার লক্ষ্য ছিল স্বল্প বিনিয়োগে বিদেশ থেকে তেল, গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজসম্পদ লুণ্ঠন করে নিজ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। এ মিশনে প্রথম দিকে কিছুটা সফলতা এলেও প্রতিরোধ যুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছিল। প্রতিনিয়ত গোলাবারুদ, অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ ও প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। দীর্ঘ দিন বিদেশে যুদ্ধরত আমেরিকার সেনাবাহিনীর মনোবল হ্রাস পাচ্ছিল। সেনাবাহিনীতে আত্মহত্যার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ট্রাম্প দীর্ঘ যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে বিদেশে আমেরিকার প্রভাববলয় ক্রমান্বয়ে সূচিত ও ব্যয় হ্রাস করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ফলে আমেরিকার অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠছিল। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা জো বাইডেন নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার লক্ষ্যে আমেরিকার কালো মানুষ ও অভিবাসীদের ভোটের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিলেন। সে কারণে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প কর্তৃক ইস্যুকৃত অভিবাসন নীতি অনেকাংশে পরিবর্তন করেছেন। নীতি শিথিল হওয়ায় আমেরিকায় অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত রিপাবলিকানরা সাদা চামড়ার মানুষদের ভোটের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বিগত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে যে, অধিকাংশ সাদা চামড়ার মানুষ রিপাবলিক পার্টির প্রার্থী ট্রাম্পকে সমর্থন করেছেন। এমনকি ট্রাম্পের শত শত মিথ্যাচারের পরও সাদা চামড়ার মানুষের এক বিশাল জনগোষ্ঠী তার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছিল। আমেরিকার দীর্ঘ দিনের নির্বাচনী নীতিমালা পাল্টে দিয়ে ট্রাম্প জোরপূর্বক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তার পরও তার জনসমর্থন একেবারে কম নয়। আমেরিকার নির্বাচনের এ দিকটা বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কারণ বিশ্বের মানুষ গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে আমেরিকার মডেল বা নীতিমালাকে অনুসরণ করে থাকে। তবে আমেরিকায় শ্রেণিবিভাজনের যে ধারা চালু হয়েছে তা সহজে নির্বাপিত হওয়ার নয়। আব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথা বাতিল করে আমেরিকার সমাজে যে সাম্যের আবহ তৈরি করেছিলেন ক্রমান্বয়ে তা বিলুপ্তির পথে।

আগামী নির্বাচনে এ শ্রেণিবিভাজন, সাদা-কালোর পার্থক্য ও অভিবাসী সমস্যার তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পাবে। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী রূপে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ বিষয়টি মাথায় রেখে ক্ষমতায় বসার দিন থেকেই তার কার্যক্রম শুরু করেছেন। তিনি অভিবাসন নীতি শিথিল করেছেন। ডিভি প্রথা চালু করেছেন। মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণ বন্ধ করেছেন। সার্বিকভাবে আমেরিকায় অভিবাসী সংখ্যা বৃদ্ধি করে আগামী নির্বাচনে তার ভোট ব্যাংক বৃদ্ধি করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি অগ্রসর হচ্ছেন। ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিরপেক্ষ ভোটব্যবস্থা নিয়ে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন, ভবিষ্যতে তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমেরিকার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করবে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন বর্ণবাদবিরোধী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। পৃথিবীর মানুষের জন্য তা ছিল এক মহান আদর্শ। অপর দিকে এ আদর্শ পরমাণু অস্ত্র হতেও শক্তিশালী হিসেবে বিবেচিত। আমরা জানি, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্লোগান তুলে আমেরিকা বা ন্যাটোজোট সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বা ওয়ারশ জোটের প্রতি আদর্শিক চরম আঘাত হেনেছিল যে অভিঘাতে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ তথা ওয়ারশ জোট মুখথুবড়ে পড়েছিল। এমনকি সে আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিশে^র মডেল বা আদর্শ খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৫টি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যায়। এ বিভাজন এখনো অব্যাহত আছে। আমেরিকার সে আদর্শিক শক্তির পরিবর্তন ঘটেছে। খোদ আমেরিকাতে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সাদা কালোর ব্যবধান বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ণবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন বিষয়টির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে তা নিরসনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বর্ণবাদের যে ভিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে রোপিত হয়েছে তা সহজে উপড়ে ফেলার নয়। সাদা মানুষদের মাঝে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে এর প্রতিফলন আরো স্পষ্ট হবে বলে আশঙ্কা করা যায়।

বিগত ২০২০ সালের নির্বাচনে সুস্পষ্টভাবে বিভাজিত ফলাফলকে কেন্দ্র করে, বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণের অনুষ্ঠানকে ঘিরে প্রতিহিংসা ও অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল আমেরিকার ইতিহাসে যার কোনো নজির নেই। দেশের সচেতন ও বোদ্ধা মহলের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। তবে বর্ণবাদ ও শ্রেণিবিভাজনের ধূমায়িত ক্ষোভ পুরোপুরি নির্বাপিত হয়নি। ‘গণতন্ত্রের সূতিকাগার’ আমেরিকার দৃষ্টান্ত কেবল আমেরিকার জনসাধারণকে প্রভাবিত করেনি, সমগ্র পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনসাধারণের উপরেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে বর্ণবাদ ও আঞ্চলিকতা প্রভাব বিস্তার করেছে। তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার প্রধানদের মধ্যে স্বৈরাচারী মানসিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমান্বয়ে পরমতসহিঞ্চুতা, বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হ্রাস পাচ্ছে। অথচ নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ নিয়ে পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয়, আমেরিকার আদিবাসী যারা ‘রেড ইন্ডিয়ান’ হিসেবে পরিচিত তারাই আমেরিকার মূল অধিবাসী। বাদবাকি সবাই ইউরোপ, আফ্রিকা ও অন্যান্য মহাদেশ থেকে আগত। দেখা যায়, আমেরিকার রাষ্ট্র পরিচালনায় কিংবা ব্যবসা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে আদিবাসীদের কোনো প্রাধান্য নেই। জাতিগত, শ্রেণীগত, বর্ণগত সমস্যার সমাধান মহানবী সা:-এর আদর্শের মাধ্যমে দূরীভূত হয়েছে। মহানবী সা: বলেছেন, কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের, কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে (তা হবে)। সব মানুষ আদম আ:-এর সন্তান, আর আদম মাটি দিয়ে সৃষ্ট। মানুষ হিসেবে সবাই সমান। কর্মের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে শ্রেণিবিভাজন হয়। বর্ণের মাধ্যমে নয়। আঞ্চলিকতা মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement