২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অর্থনীতি বাঁচলে দেশ বাঁচবে

অর্থনীতি বাঁচলে দেশ বাঁচবে - ছবি : প্রতীকী

দেশ এগোচ্ছে। প্রায় সব অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচক এ কথাই বলছে। উন্নয়নের এই চিত্র আমাদেরকে আশাবাদী করে তোলে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি বড় গোমর এটাই যে, এর চালিকাশক্তি হলো বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা এবং তাদের ‘অসম্ভবকে সম্ভব করার’ যোগ্যতা। (এই কথাটার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পরে দিচ্ছি)। বেসরকারি খাতের ভূমিকা কম বেশি সব দেশেই প্রণিধানযোগ্য, বিশেষ করে মুক্ত অর্থনীতির দেশগুলোয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ কথা বলতেই হবে, এখানকার ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি বহনের সাহস, উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব, বিক্রয় এবং সরবরাহ প্রবাহে তাদের দক্ষতা সত্যি পাঠ্যবইয়ের সংজ্ঞাকেও হার মানায়। অথচ তারা দেশের জিডিপিতে এতটা অবদান রাখার পরও রাষ্ট্রের আনুকূল্য আনুপাতিক হারে খুব কমই পেয়ে থাকেন।

অযৌক্তিক কর-চাপে তারা পিষ্ট; সামাজিক দুষ্টচক্রের হাতে তারা এক ধরনের পণবন্দী, চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ। সরকার রাষ্ট্রের পক্ষে তাদের উদ্যোগের সমন্বয়কারী না হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর রাজস্ব জুলুমের ধারাটিই বহাল রেখেছে। গ্যাস-পানি বিদ্যুতের মাত্রাতিরিক্ত রেটে তারা নাকাল। ব্যাংকঋণ না নিলে করের চাপ; নিলে সুদের চাপ। এত চড়া সুদ আর কোনো দেশের ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদেরকে নিতে হয় কিনা জানি না। মনে হয় কোনো দেশেই ব্যবসায়ীদের ওপর করের খড়গ এতটা অনিবার্য নয়। তা’ না হলে ভ্যাট-করে পিষ্ট উদ্যোক্তারা পদে পদে এত মার খাচ্ছেন কেন?

পাটের দেশ বাংলাদেশের পাট নিয়ে গিয়ে অন্য দেশগুলো এত কম দামে বিশ্ববাজারে প্রাধান্য বজায় রাখছে কিভাবে? পৃথিবীর বহু দেশ এরই মধ্যে প্লাস্টিক, সিনথেটিক্স ও পলিমারের বাজারের থলি/শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে; তার বদলে চলছে কাগজের ব্যাগ। পরিবেশবাদীদের চাপে সেই কাগজের ব্যাগের বদলে এখন চালু হয়েছে কাপড় ও পাটের থলি। কাপড়েরও দোষ আছে। কম দামি কাপড় মানেই নকল আঁশে তৈরি (সিনথেটিক্স); কেবল পাটের থলিই ১০০ শতাংশ প্রাকৃতিক। সেই পণ্যটির রফতানি বাজার দখলে আমরা কার্যত ব্যর্থ কেন হবো? আজ এই ব্যর্থতার কারণ সন্ধানের পালা। কর্মকর্তারা আছেন তাদের নিয়োগ-বদলি, বেতন-ভাতা, পদ-পদায়ন-বদলি, গাড়ি-কোয়ার্টার-প্রমোশন-গ্র্যাচুইটি এই সব নিয়ে। যে কর্মকর্তা যে শিল্পের বা যে খাতের সাথে যুক্ত তিনি সেই কর্মক্ষেত্রের ষোল আনা বুঝে ওঠার আগেই এসে যায় তার বদলি আদেশ কিংবা পদোন্নতি পেয়ে অন্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগে যোগ দেয়ার পালা। এটা আমাদের দেশের জনপ্রশাসন ব্যবস্থাপনা ও নীতির একটা বড় সীমাবদ্ধতা। পৃথিবীর বহু দেশে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই যেখানে একজন কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপক কোনো কর্মক্ষেত্রে তরুণ বয়সে সেই যে ঢোকেন, অবসর নেয়া পর্যন্ত সেই খানেই অভিজ্ঞ এবং দক্ষ হয়ে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে যান। এতে দেশ উপকৃত হয়; শিল্পক্ষেত্র বা খাত উপকৃত হয়। বিপরীত বিবেচনায়, বদলিযোগ্য চাকরির ক্ষণস্থায়িত্ব নিয়েও কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপক দেশের খেদমত করতে পারেন, যদি তিনি সৎ হন এবং মেধা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ওই অল্প সময়ের মধ্যেও তিনি কর্মক্ষেত্রের সব কিছু জেনে নিতে পারেন। বরং কর্ম ও অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যই একজন প্রশাসক বা সরকারি কর্মকর্তার শিক্ষা ও জ্ঞানের পরিচায়ক।

শুধু কর্মকর্তাই নয়, দেশের তিনটি কর্মশাখা, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন সভা (বা সংসদ) সবাইকেই হতে হবে ব্যবসা বা উৎপাদন-বান্ধব তথা অর্থনীতির প্রতি সংবেদনশীল। এখানে অহঙ্কার, অহমিকা, দম্ভ-দাম্ভিকতা, রাজনৈতিক আবেগ বা ভাবাবেগ, ক্ষমতার লোভ, বাড়াবাড়ি, আইন-শৃঙ্খলার মতো বিষয় নিয়ে হেলাফেলা বা দায় এড়ানোর মানসিকতা, এগুলো বাদ দিতে হবে। অর্থনীতি বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচলে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামার খেলা অনেক করা যাবে। অর্থনীতি বাঁচাতে পারলে জনগণের জীবনমান ভালো হবে। এই করোনা-কালেই মানুষকে বাঁচাতে হবে। কেবল চড়া দামে টিকা কিনে এনে সুঁই ফুটিয়ে মানুষ বাঁচানো যাবে না। বিশ্বের দেশে দেশে ‘গণশত্রুরা’ কোভিড-১৯-এর চেয়েও ভয়াবহ।

রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার ও অসৎ ব্যবসায়ী- এই ত্রিভুজ চক্র এক সাথে কাজ না করলে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে এত ঘাপলা হয় কেন? এত টাকা, এত কিস্তি, খেলাপিই বা হয় কিভাবে? যেখানে জবাবদিহিতা থাকে সেখানে সততা ও স্বচ্ছতা কাঠামোগত রূপ না পাওয়ার কোনো কারণ থাকে কি? সমৃদ্ধির যে মহাসড়কে আমরা এখন উঠেছি, শুধু সততা-জবাবদিহিতা এবং দেশপ্রেম থাকলে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের জটাজাল ভেদ করে আমরা সুদিনের আলো দেখতেই পারি। এ জন্য সবার আগে চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা। মাছের মাথা থেকেই পচন শুরু হয়। তার পর সে পচন ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেহে। ঠিক যেমন ক্যান্সার। প্রথমে শুরু হয় একটা গোটা, লাম্প কিংবা আক্রান্ত অঙ্গে। তার পর প্রতিরোধ, প্রতিকার না করলে সেটা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। এ জন্যই বিকিরণ-চিকিৎসায় প্রথম আঘাতটি হানতে হয় লক্ষ্যবস্তুর ওপর, যাকে ডাক্তাররা বলেন, ‘টার্গেটেড রেডিও থেরাপি।’ সরকার নিজেই শাসক-প্রশাসক, নীতিনির্র্ধারক। সরকার নিজেই যদি বণিকচক্র ও অসাধু কর্মকর্তাদের কাছে ধরা দেয় কিংবা তাদেরকে কাজে লাগিয়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকে, তাহলে সেই সংক্রমণ রোধ করা অসম্ভব হয় পড়ে। ব্যাংকের পরিচালকরা নিজেই ঋণ নেন। রাজনীতিবিদদের ‘মনোনীত’ ব্যবসায়ীদেরকেই কাজের ঠিকা দেয়া হয়। সরকারি সম্পদ-সম্পত্তি জবর দখল করেন সরকারি দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়পুষ্ট লোকেরাই। তাহলে দুর্নীতির এই মরণ ক্যান্সার সারাবে কে?

কেউ কেউ বলবেন, যেখানে কাজ হয় সেখানে কিছু অনিয়ম হওয়াটা বিচিত্র নয়। এটা একেবারেই সত্যের অপলাপ। বেশি কাজ মানেই জনগণের জন্য বেশি সেবা, খেদমত। কাজেই কাজ বেশি-কমের সাথে দুর্নীতি জোচ্চুরির সম্পর্ক কোথায়? কাজ না করে বছর শেষে প্রাক্কলিত টাকা রাজকোষে ফেরত দেয়ার মধ্যে কোনো সফলতা নেই, এ কথা সত্য। তবে কাজের নামে যদি চলতে থাকে পুকুরচুরি, আত্মসাৎ, তছরুপ, তাহলে? এই যে শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, এগুলো বেশি কাজের নমুনা নয়। এ হলো বেশি বেশি পুকুর চুরির দৃষ্টান্ত। আর এই দৃষ্টান্তগুলোই এখন আমাদের সম্পদ। জনগণ খেটে মরছে, দুষ্টচক্র লুটপাট করছে। কোনো বিকার নেই কারো মধ্যে। পুকুর চুরির খবরে কাগজের পাতা উপচে পড়ছে। অথচ এর একরত্তি দৃষ্টান্ত থাকলে অন্য দেশে আগুন জ্বলে উঠতো, রাজপথে ‘রায়ট’ শুরু হতো।

কতই না দুর্ভাগা এ দেশের সাধারণ মানুষ। দেশে সরকারের ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়ার জন্য বিরোধী দল লাগে। এখানে প্রধান বিরোধী দলটি হামলা-মামলা, অন্যায়-অবিচারে অবশ হয়ে পড়ে আছে। এত এত সঙ্কটের গজব নামে। বিরোধী দলকে কোনো ভূমিকায় থাকতে দেখা যায় না। কিভাবে যাবে? তারা তো তাদের অস্তিত্ব নিয়েই বেসামাল। আর যারা ক্ষমতার হিস্যা পাওয়া তথাকথিত বিরোধী দল, অর্থাৎ ‘হার ম্যাজেস্টিজ লয়্যাল অপোজিশন’ তাদের উপায় নেই সরকার বা সরকারি দলের সমালোচনা করার। কারণ, তারা নিজেরাই তো সাবেক বা বর্তমান উচ্ছিষ্টভোগী, বিশ্বস্ত সহযোগী। ভয় আছে তাদের ‘সহিহ্ আমলনামা’ প্রকাশিত হওয়ার। তা ছাড়া সেই সৎসাহস বা সদিচ্ছা কোনোটিই তাদের খাসিলতে নেই।

প্রতিবাদহীন ক্ষমতার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরই নিয়ম। এর অন্যথা হয় কিভাবে? থাইল্যান্ড থেকে নিকারাগুয়া, সেনেগাল থেকে পাপুয়া নিউগিনি, বিশ্বের দুর্নীতির মানচিত্রে এর নজির ভূরি ভূরি। প্রতিবাদী হয়ে ওঠার খেসারত দিচ্ছে আজ রাশিয়ার বিরোধী দল। রাস্তায় জড়ো হলেই তাদের ওপর নেমে আসছে পুলিশি ব্যাটন, গরম পানি বা কাঁদানে গ্যাসের হামলা। তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর ‘অপরাধে’ সাংবাদিক, অধ্যাপক, গবেষক এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে হেনস্তা হতে হচ্ছে। সেখানে পুতিনের কথাই শেষ কথা। শাসক দলের ওপর একটা ‘টুঁ’ শব্দ করা যাবে না। মিসরে কী হচ্ছে? যে আরব বসন্তে জেগে উঠেছিল গোটা আরব জাহান, তারা আজ দুঃশাসন ও দুর্নীতির জাঁতাকলে পিষ্ট। গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় এসেও মিসরের ব্রাদারহুড আজ নিজ দেশেই নির্বাসিত। আল জাজিরার সাংবাদিক আজ দুই বছরেরও বেশি মিসরের কারাগারে। তবু তো সে বেঁচে আছে। আদনান খাসোগীকে তো অন্যায় এবং স্বৈরাচারের প্রতিবাদ জানানোর খেসারত দিতে হয়েছে পৈশাচিকভাবে খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে। তার লাশ পর্যন্ত কেটে টুকরো টুকরো করে এসিডে জ্বালিয়ে ভস্ম করা হয়েছে। কাজেই গণতন্ত্র কোথাও নেই। এমনকি খোদ মার্কিন মুলুকেও নেই, যতই তারা আড়াই শ’ বছরের সাংবিধানিক শাসনের কথা মুখে বলুক না কেন।

করোনাটা গেলে বিশ্বকে যেমন বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, তেমনি শাসনব্যবস্থা নিয়েও ভাবতে হবে। ভাবতে হবে লাভ, লোভ ও সুদি অর্থ এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার নতুন বিন্যাস নিয়েও। জানি না, আমরা কে কোথায় কিভাবে ততদিন বেঁচে থাকব। তবে যারা বেঁচে থাকবেন, তারা অন্তত দেখে যেতে পারবেন, পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত মঙ্গল, কল্যাণ ও সাম্যেরই বিজয় হবে।


আরো সংবাদ



premium cement