‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড।’ যে জাতির শিক্ষা নামক মেরুদণ্ডটি যত শক্তিশালী, সে জাতি তত বেশি টেকসই উন্নয়নের অধিকারী। উন্নয়নের অনেকগুলো উপাদান থাকতে পারে, কিন্তু কোনোটাই শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোনো জাতিকে স্থায়ীভাবে ধ্বংস করতে চাইলে তার শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করলেই চলে। উন্নত দেশগুলোতে সে কারণেই শিক্ষাক্ষেত্রের ব্যয়কে সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হয়। তারা শিক্ষা-উন্নয়নের ইস্যুটিকে জাতীয় যেকোনো ইস্যুর ওপরে স্থান দিয়ে থাকেন।
শিক্ষার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হচ্ছেন শিক্ষক। অন্যভাবে বলা যায়, জাতির মেরুদণ্ড নির্মাতা হচ্ছেন শিক্ষক সম্প্রদায়। শিক্ষকের মর্যাদা, গুরুত্ব ও অবদান যে কত বেশি, তা বোঝা যায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মদ সা:-এর বিখ্যাত উক্তির মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি’ (মিশকাত)। একটি জাতির মানস গঠন ও উন্নয়নে শিক্ষক মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলোর প্রচেষ্টায় ও ইউনেস্কোর ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৯৫ সালের ৫ অক্টোবর থেকে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী দিনটিতে পালন করা হয় ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। এর মাধ্যমে মূলত সারা বিশ্বে শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার বিষয়ে তাগিদ দেয়া হয়। বাংলাদেশের জন্মের পটভূমি ও মহান মুক্তিসংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন শিক্ষক সমাজ। সচেতন মহলে এবং বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন, কতটা মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করতে প্রস্তুত এ জাতি তার মেরুদণ্ড নির্মাতাদের জন্য?
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুকাল পর থেকেই শিক্ষক সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসতে থাকে অন্তহীন বৈষম্য। বাংলাদেশের স্তরভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরের শিক্ষকেরা সীমাহীন বৈষম্যের শিকার। কোনো বিষয়ে বৈষম্য খুঁজতে হলে দু’টি সমপর্যায়ের বিষয়ের বিভিন্ন দিক উপস্থাপন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ দু’টি ক্যাডারের তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করা যেতে পারে।
একই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে তিন-চার লাখ যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থীকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের ক্যাডার সার্ভিসে প্রবেশ করেন গুটিকয়েক বিজয়ী প্রার্থী। ২৮টি ক্যাডারে বিভক্ত হয়ে তারা রাষ্ট্রকে সেবা দিয়ে যান। সঙ্গত কারণেই মর্যাদা, সুবিধা বা অন্যান্য দিক থেকে রাষ্ট্রের সেবক এই ক্যাডারদের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকার কথা নয়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বারবার নির্দেশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু সমস্ত আইন ও অনুশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোন এক অশুভ শক্তির ইশারায় ক্যাডার সার্ভিসে বিদ্যমান রয়েছে অসহনীয় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য। তা দিন দিন শুধুই বাড়ছে। এর মধ্যে বিষম বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে শিক্ষা ক্যাডারদের। যে কয়েকটি বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে, তার কয়েকটি নিম্নরূপ-
এক : পদোন্নতি যেকোনো সার্ভিসের অধিকার। নির্ধারিত সময়ে পদোন্নতি পেলে যেমন কর্মীদের মনোবল ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পায়, তেমনি পদোন্নতি বঞ্চিত হলে তাদের মধ্যে বাসা বাঁধে হতাশা আর ক্ষোভ। বাংলাদেশের শিক্ষা ক্যাডারে বর্তমানে কোনো কোনো বিষয়ে ২৬তম বিসিএস থেকে শুরু করে ৩৬তম বিসিএস পর্যন্ত (১১টি ব্যাচ) একইসাথে প্রভাষক পদে কর্মরত রয়েছেন। অথচ কৃষি, তথ্য, প্রশাসন ও আনসারসহ বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারের ৩১তম ব্যাচের সদস্যরা এক বছর আগেই কাক্সিক্ষত পদোন্নতি লাভ করে শিক্ষা ক্যাডারের এসব সদস্যদের ওপরের গ্রেডে অবস্থান করছেন।
দুই : ক্যাডার সার্ভিস হতে হয় ল্যাডারভিত্তিক। অর্থাৎ প্রতিটি সার্ভিসের এন্ট্রি থেকে সংখ্যানুক্রমিকতার ভিত্তিতে ঊর্ধ্বতম গ্রেড পর্যন্ত পদ থাকতে হয়। বিসিএস প্রশাসনসহ পুলিশ ও অনেক ক্যাডারে সুপার গ্রেডের পদ সৃষ্টি করা হলেও শিক্ষা ক্যাডারে চতুর্থ গ্রেডের ঊর্ধ্বে নিয়মিত পদ নেই। একটি জাতির শিক্ষার ক্ষেত্রে এ অবস্থা সে জাতির অসহায়ত্বেরই বহিঃপ্রকাশ।
তিন : বাংলাদেশের শিক্ষা ক্যাডারের সার্ভিসটি অবকাশ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। অথচ এই ক্যাডারের সদস্যরা কখনোই অবকাশকালীন নির্ধারিত ছুটি ভোগ করতে পারেন না। তথাপি শুধু আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে ক্যাডার সদস্যদের অভিমত। একটি জাতির শিক্ষা বিভাগকে সরকারিভাবে অবকাশ বিভাগ ঘোষণা করে শিক্ষাকে অবকাশে পাঠালে সমগ্র জাতির উন্নয়নও অবকাশে যেতে বাধ্য।
চার : রাষ্ট্রীয় মর্যাদার ক্রমে শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের জন্য কোনো স্থান নির্ধারণ করা হয়নি। শিক্ষককে বাদ রেখে এই মর্যাদার ক্রমটি সৃষ্টি করেছিল সামরিক সরকার। পাঁচ : শিক্ষা ক্যাডারে অনুসৃত হয় না কোনো বদলি নীতিমালা। ফলে যুগ যুগ ধরে একই কর্মস্থলে এই ক্যাডারের সদস্যদের চাকরি করতে হয়। ছয় : বিভিন্ন ক্যাডারের সদস্যদের সবার জন্য একটি নির্দিষ্ট স্তর থেকে সরকারি পরিবহনের ব্যবস্থা (সাথে আকর্ষণীয় ব্যবস্থাপনা ভাতা) থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারের একজন জ্যেষ্ঠ সদস্যের জন্যও সে সুযোগ রাখা হয়নি। শিক্ষা ক্যাডারের একজন সদস্য হেঁটে অথবা গণপরিবহন ব্যবহার করে সরকারি দায়িত্ব পালন করার সময় সমগ্র জাতির দীনতাই প্রকাশ পায়। সাত : কর্মক্ষেত্রে পেশিশক্তিতে শক্তিমান আর অন্যান্য প্রভাবশালী ক্যাডারের দাপটে প্রায়ই শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়।
এই দেশে শিক্ষককে কানে ধরে ওঠবস করান, শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষিকার শ্লীলতাহানি করা, শিক্ষা ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ সদস্যকে অন্য ক্যাডারের সদস্যের পা ধরতে বাধ্য করা এবং সেটিকে ক্যামেরায় ধারণ করে সামাজিকমাধ্যমে সাড়ম্বরে প্রকাশ করার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। এভাবে কি আসলে শিক্ষা ক্যাডারের একজন সদস্যকে পদদলিত করা হয়েছিল, নাকি সমগ্র জাতির বিবেককে? আট : ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণাকে সামনে রেখে এগিয়ে চলছে দেশ। এই এগিয়ে চলার শক্তি জুগিয়েছে শিক্ষা। সমগ্র দেশের দায়িত্বশীল সরকারি কর্মচারীদের দাফতরিক কাজের জন্য টেলিফোন ও ইন্টারনেট ভাতা প্রদান করার যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা সময়েরই দাবি। কিন্তু ইন্টারনেটের ব্যবহার যে বিভাগের জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য সেই শিক্ষা এবং শিক্ষা ক্যাডারের সাধারণ সদস্যদের রাখা হয়েছে এই প্রক্রিয়ার বাইরে। শিক্ষা নিয়ে গবেষণা, বই ক্রয়ের জন্য কোনো ধরনের প্রেষণা তো সরকারি তরফ থেকে দেয়া হয়-ই না, বরং তথ্য ও প্রযুক্তির সম্পূর্ণ ব্যবহার থেকেও এই ক্যাডারের সদস্যদের বিরত রেখে দেশকে পিছিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। ক্যাডারভিত্তিক সার্ভিসে এমনিভাবে শিক্ষার প্রতি কত বৈষম্য রয়েছে সেজন্য স্বতন্ত্র গবেষণার দাবি রাখে।
এই আলোচনায় দু’টি সমপর্যায়ের ক্যাডার সার্ভিসের তুলনা করা হয়েছে। বৃহৎ পরিসরে যদি দেশটির সামগ্রিক শিক্ষার সাথে অন্যান্য রাষ্ট্রের শিক্ষা ও শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা, মর্যাদা এবং অন্যান্য দিক নিয়ে তুলনা করা হয় তাহলে যা পাওয়া যাবে তা শুধুই হতাশার চিত্র। অথচ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, বেড়েছে সক্ষমতা। শুধু দিনে দিনে কমেছে শিক্ষকের মর্যাদা। বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষকের হৃদয়ে করুণ সুরে ধ্বনিত হয় জনপ্রিয় কথাশিল্পী আশরাফ সিদ্দিকীর ‘তালেব মাস্টার’ কবিতাটি। যেন দেশের প্রতিটি শিক্ষকই এক একজন ‘তালেব মাস্টার’। ফলে এ দেশের মেধাবীরা আর শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নিতে চাইছেন না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সামাজিক মর্যাদা লাভের আশায়, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আর আত্মসম্মানের জন্য মেধাবীরা দলে দলে ছাড়ছেন শিক্ষকতা পেশাটি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ও শিক্ষককে যথাযথ মর্যাদা দিতে না পারলে, শিক্ষকতাকে মেধাবীদের প্রথম পছন্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে শিক্ষা বিভাগটি সম্পূর্ণরূপে মেধাহীন হয়ে পড়বে। যে জাতি শিক্ষাকে, শিক্ষককে মুখ্য প্রয়োজন মনে করে না; সে জাতির ভবিষ্যৎ কতটা ভালো হবে? তবে আশার কথা, সরকার এ বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলে দ্রুতই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক: এমফিল গবেষক, জাবি; বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা