২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বেদেদের আদি নিবাস ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে যা জানা যায়

বেদেদের আদি নিবাস ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে যা জানা যায় - ছবি : নয়া দিগন্ত

প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীর আদি ও আসল নিবাস রয়েছে। তেমনি বেদে সমাজের আদি ও আসল পরিচয় রয়েছে। তবে সেটি নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। অনেকেই তাদেরকে আরব বেদুঈনদের একটি অংশ আবার কেউ কেউ তাদের উপমহাদেশের আদি অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

বেদেদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস হলো, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা:-এর সময়ে আরবে বেদুঈন ছিল। যাদেরকে যাযাবর বলা হতো। তারা মনে করেন যে বেদুঈনদের একদল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় তারা অন্য বেদুইনদের শত্রুতার শিকার হয়, ফলে তারা মুহম্মদ সা:-এর নির্দেশে আরব ছেড়ে ভারত উপমহাদেশে চলে আসে।

তবে বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, বেদেরা বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) মনতং আদিবাসী সম্প্রদায়ের উওরসূরি একটি দল হিসেবে হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বেদে সমাজের শিক্ষিতদের ধারণা, তারা খাঁটি ‘অ্যারাবিয়ান’ বা বেদুইন। যাদেরকে আরব মূল জাতিগোষ্ঠীর আরবে বায়দা বলা হয়। তাদের বিশ্বাস, খ্রিষ্টীয় সাত শতকের শেয়ের দিকে তাদের পূর্বপুরুষরা আরব উপদ্বীপের ‘আল-বাদিয়া’ নামক বন্দরে বাস করতেন। তাদের জীবিকার মূল উৎস ছিল উট, দুম্বা ও গাধা তথা পশুপালন। এসব পালিত পশুর খাদ্যের খোঁজে তারা ক্রমে নিকটবর্তী সমতলভূমিতে আসার চেষ্টা করত। এভাবেই মরুভূমি ছেড়ে কেউ আফগানিস্তানে, কেউ পাকিস্তানে এবং কেউ ভারতে ঢুকে পড়ে।

তাদের মতে, এভাবেই আরব বেদুইনদের একটি অংশ বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে এবং ক্রমে তারা বেদে নামে পরিচিতি লাভ করে। সময়ের পরিক্রমায় আজ উট-দুম্বা না থাকলেও যাযাবর জীবনের নির্যাসটুকু আজও তাদের রক্তে মিশে রয়েছে বলে জানান বিক্রমপুরের বেদেপল্লীর মাতব্বর মো: মমিনুল ইসলাম।

তবে সাভার পোড়াবাড়ির অমরপুরের মনতাজ আলী মাতব্বরের দাবি, তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন ‘ইরানের’ অধিবাসী। ইংরেজিতে যাদেরকে বলা হয় ‘জিপসি’।

তার এ কথার মিল পাওয়া যায় প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক ডাটন-এর কথার সাথে। তিনি বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়কে জিপসিদের মতো যাযাবর জনগোষ্ঠী বলে উল্লেখ করেছেন। ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানরাজ বল্লালরাজের সাথে তারা ঢাকায় আসে। পরবর্তীতে তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়।

নৃতাত্ত্বিক ডাটন উল্লেখ করেন, বেদেরা প্রথমে বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে। পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ছড়িয়ে পড়ে। এই জনগোষ্ঠীর ৯০ ভাগই নিরক্ষর হলেও এখন অনেকেই শিক্ষার ব্যাপারে সচেতন হয়েছে।

জানা গেছে, বেদে নামটি বাইদ্যা (হাতুড়ে ডাক্তার), পরিমার্জিত ‘বৈদ্য’ (চিকিৎসক) থেকে উদ্ভূত। যা একটি অবজ্ঞাসূচক শব্দ। বেদেই চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ততার কারণে মনতংরা কালক্রমে বেদে নামে অভিহিত হয়। বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসীদের দেশত্যাগী অংশ। তাই তারা নিজেদের মনতং বলে পরিচয় দিতে বেশি আগ্রহী। যুদ্ধ ও শিকারে অতিশয় দক্ষ বেদেরা জাতি হিসেবে কষ্টসহিষ্ণু ও সাহসী। এদের গাত্রবর্ণ ও আকৃতি বাঙালিদের মতোই।

জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বাংলাদেশের বেদেরা ইসলাম ও হিন্দু উভয় ধর্মই মেনে চলে। তবে ধর্মীয় পরিচয়ে তারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করেন। মুসলিম ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী নিজেদের সমাজের মধ্যে মৌলভীর মাধ্যম বিয়ে হয়। তবে নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে কেউ বিয়ে করলে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়। তাদের মাঝে তালাক প্রথাও প্রচলিত আছে। বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে স্ত্রীর ইচ্ছায়। এ ক্ষেত্রে বিয়ের সময় স্বামীর দেয়া যৌতুকের অর্ধেক তার পরিবারকে ফিরিয়ে দিতে হয়।

ধর্ম পালনের অংশ হিসেবে বেদেরা মুসলিমদের মতো ওয়াক্তিয়া নামাজ ও জুমার নামাজ আদায় করে। এমনকি তারা ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবে বরাত ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসব পালন করে। তাদের মধ্যে পীরের প্রভাব লক্ষণীয়। বিভিন্ন দরগায় ওরশের সময় উপস্থিত থেকে নানা মানত করে।

এক সময়ে তাদের সরদার মারা গেলে তার কবরের ওপর মাজার নির্মাণ করতেন। এখন অবশ্য এসবের প্রচলন নেই। কেউ মারা গেলে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাদের দাফন করা হয়। তারা কুলখানি ও চল্লিশা পালন করে। তবে রোজার ব্যাপারে তাদের মধ্যে শিথিলতা দেখা যায়। নিজেদের তারা মুসলমান দাবি করলেও অনুকরণবাদী চরিত্রের কারণে তারা শিব, ব্রহ্মা ও মনসায় বিশ্বাস করে।

দরিদ্র এ জাতিগোষ্ঠীর নারী সমাজের মধ্যে পর্দার তেমন প্রচল দেখা যায় না। তবে কিছু কিছু এলাকায় বর্তমানে স্বচ্ছল পরিবারের মেয়েদের মধ্যে বোরকা ও হিজাবের প্রচলন শুরু হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement