০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনের আহাজারি থামছে না

রেললাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রক্ত
-

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত লোকজনের পরিবার ও স্বজনদের আহাজারি থামছে না। এই দুর্ঘটনায় কারো ছেলে, কারো বাবা, কারো মা কিংবা কারো স্বামী নিহত হয়েছেন। নিহত প্রত্যেকের জীবনের গল্প আলাদা। এদের কেউ রিকশা চালক, কেউ শ্রমিক, কেউ ছাত্র, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেউ গৃহিণী, কেউ আবার চাকরিজীবী। নিহতদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। তবে তারা হারিয়ে যাওয়ায় স্বজনদের সবার দুঃসহ বেদনা-কষ্টের অনুভূতি একই ধরনের। নিহতদের বাড়িতে বাড়িতে চলছে আহাজারি।
ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলে মঙ্গলবার সকাল থেকে উৎসুক জনতার ভিড় ছিল। শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ সেখানে ছুটে যায়। সবার চেহারায় আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার ছাপ, মুখে ট্রেন দুর্ঘটনার কথা।
সরেজমিন দেখা যায়, দুর্ঘটনাস্থলে রেললাইনের যেখানে-সেখানে মানুষের রক্ত লেগে আছে। রেললাইনের ফিশপ্লেটে নিহত ব্যক্তিদের হাড়, হাতের আঙুল, গলে যাওয়া মস্তিষ্কসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পড়ে রয়েছে। এসব থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। যাত্রীদের সাথে থাকা চাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিসপত্রও এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। আশপাশে ভিড় করেছে অসংখ্য মানুষ। তারা নাক-মুখ চেপে ঘটনাস্থলে ঘুরে ঘুরে পড়ে থাকা বিভিন্ন জিনিস দেখছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত এ দৃশ্য ছিল।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার পানাহার গ্রামের মৃত জালাল উদ্দিনের ছেলে মো: সফিকুল (৩৪) ঢাকার নূরেরছালা এলাকায় ভাঙ্গারি ব্যবসার হকারি করতেন। নিজের কোনো সহায় সম্পদ নেই। বাড়িতে ২ শতাংশ জায়গায় টিনের ছাপরা দুটি ঘর। বাবা মারা যাওয়ার পর মা, ছোট তিন ভাই, দুই বোন, স্ত্রী ও তার তিন শিশু সন্তান তাওসিন (৬), আবির (৩) ও সাইফাকে (১) নিয়ে ছিল তার সংসার। বাবার বড় সন্তান হওয়ায় পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব ছিল তার ওপর। গত শুক্রবার তিনি ঢাকা থেকে বাড়িতে এসেছিলেন। আরেক ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী গ্রামের প্রতিবেশী ভাগ্নে রুবেল মিয়াকে নিয়ে বাড়িতে আসেন। সোমবার ওই ভাগ্নেকে নিয়েই তিনি ঢাকায় ফিরছিলেন এগারসিন্দুর গোধূলি এক্সপ্রেসে। রেল দুর্ঘটনায় পড়লে দু’জনেই বগির নিচে চাপা পড়েন। ঘটনাস্থলে মারা যান সফিকুল। রুবেল গুরুতর আহত অবস্থায় কিশোরগঞ্জের একটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টায় পানাহার গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সফিকুলের বাড়িতে প্রতিবেশী ও স্বজনেরা ভিড় করেছেন। একটু আগেই নামাজে জানাজা হয়েছে। বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
স্বজনরা জানান, সফিকুল তার সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। মা হারেছা আক্তার কান্না করে বলছিলেন, ‘ও আল্লাহ আমার পুতেরে কেন নিয়া গেলা? আমরা এহন কি কইরা বাঁচাম। আমার পুত আমারে অনেক যতœ করতো, আল্লাহ গো, আল্লাহ। আমার পুতেরে কেন নিয়া গেলা’।
স্ত্রী খাদিজা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। আর বলছিলেন, ‘আমার তিন সন্তান এতিম অয়া গেল, আমার সন্তানরা আর বাপের মুখ দেখত পারত না। আল্লাহ আমরারে এত কষ্ট কেরে দিলা।’
বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের ডুয়াইগাঁও গ্রামের মৃত আবুল হাইয়ের ছেলে আছিরউদ্দিন (৪০) নরসিংদী জেলার বালুরঘাট এলাকায় রিকশা চালাতেন। তিনি তিন ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে সেখানেই থাকতেন।
বড় ছেলে রনির ৪০ দিন বয়সী শিশু সন্তানকে দেখতে স্ত্রী, ছোট ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে শনিবার পিরিজপুরের বাড়িতে এসেছিলেন। পুত্রবধূ, ৪০ দিন বয়সী নাতি নিয়ে সোমবার তারা ট্রেনে করে নরসিংদী ফিরছিলেন। ফেরার পথে ওই রেল দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। গতকাল ফজরের নামাজের পর জানাজা শেষে ঘরের পাশে তার লাশ দাফন করা হয়। গতকাল দুপুরে তার বাড়িতে গেলে হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে। আধা শতাংশ জায়গায় ভাঙ্গাচুরা তার একটি টিনের ঘর। স্বামীর এমন মৃত্যুতে স্ত্রী আছিয়া আক্তার বিলাপ করে কাঁদছিলেন। আছিয়া কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, ‘একমাত্র নাতিকে নিতে তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। মানিকখালি রেল স্টেশন থেকে তারা এগার সিন্দুর ট্রেনে উঠেছিলেন। সিট পাননি। তাই তারা ট্রেনের দরজার পাশে ব্যাগ বিছিয়ে বসেছিলেন। হঠাৎ করে ট্রেনটা কেঁপে উঠে। আছিয়া বলেন, ‘বিকট শব্দে আমাদের ট্রেনের বগি উল্টে যায়। আমার নাতিকে আমার ছেলের বউ আঁকড়িয়ে ধরে উপর হয়ে শুয়ে পড়ে। তখন শত শত মানুষ আমাদের ওপরে এসে পড়ে। আমার স্বামী আমার নাতিকে বাঁচানোর জন্য যায়। এ সময় ট্রেনের দরজা দিয়ে তিনি নিচে পড়ে যান। আমরা ট্রেনের ভিতরে দুই তিন ঘণ্টা আটকা ছিলাম। আমার স্বামী চাকার নিচে পড়ে মারা যায়। তার হাত পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’
মেজো ছেলে রকি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার আব্বা খুব সহজ সরল মানুষ ছিলেন। ১ শতাংশ জায়গায় একটা ঘর বেঁধে আমরা থাকি। আমরা খুব গরিব মানুষ। ঘরের পিছে একটু জায়গায় আব্বাকে কবর দেয়া হয়েছে।’
সোমবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিমে আউটার সিগনালের সামনে কিশোরগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ‘এগার সিন্দুর এক্সপ্রেস’ ট্রেনের পেছনের তিনটি কোচে মালবাহী একটি ট্রেন ধাক্কা দিলে যাত্রীবাহী ট্রেনের পেছনের দু’টি কোচ উল্টে যায়। এতে আছির উদ্দিন ও সফিকুল ছাড়াও আরো ২২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। আহত হয় বহু মানুষ।
সোমবার ঘটনাস্থল থেকে র‌্যাব, পুলিশ, সাধারণ মানুষ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করে। বাকিরা বিভিন্ন হাসপাতালে ও ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান।
আহতদের মধ্যে শতাধিক লোক ঢাকা, বাজিতপুর ভৈরব ও কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন হাসপাতালে এখনো কাতরাচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেরই হাত বিচ্ছিন্ন, পা বিচ্ছিন্ন, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর যখম। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
জানা গেছে, দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ জনকে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ২১ জনকে ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। অন্যান্য হাসপাতালে নেয়া হয় আরো অন্তত ৩০ জনকে। বাজিতপুরের জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১২ জন। চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন পাঁচজন। গুরুতর আহত থাকায় ওই হাসপাতাল থেকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে চারজনকে। এ ছাড়া ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, বাজিতপুর, কুলিয়ারচর, আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদীর বিভিন্ন হাসপাতলে শতাধিক লোক ভর্তি আছেন।
ভৈরব রেল স্টেশনের ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় নিহত ২৪ জনের মধ্যে বেশির ভাগের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- কিশোরগঞ্জের ভৈরবের রাধানগরের আবদুল মান্নান মিয়ার ছেলে আফজাল হোসেন (২১), ময়মনসিংহ জেলার ভারপাড়া এলাকার জুনাইদ মিয়ার স্ত্রী জোসনা আক্তার (১৬), কুলিয়ারচর উপজেলার লক্ষ্মীপুর এলাকার জিল্লুর রহমানের ছেলে হুমায়ুন কবির (৫৭), বাজিতপুর পিরিজপুর এলাকার আবদুল হাই মিয়ার ছেলে আছির উদ্দিন (৪৪), কিশোরগঞ্জের ভৈরবের রানীবাজার এলাকার প্রবোদ চন্দ্র শীলের ছেলে সনুজ চন্দ্র শীল (৫০), একই উপজেলার শ্রীনগর এলাকার মানিক মিয়ার ছেলে রাব্বি মিয়া (৩০), কিশোরগঞ্জের চান্দপুর এলাকার চান মিয়ার ছেলে সাইমন মিয়া (২২), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বড়ইচড়া এলাকার সুরত আলী মিয়ার ছেলে নিজাম উদ্দিন সরকার (৬৫), ঢাকা জেলার দক্ষিণ খান এলাকার আব্দুর রহমান মিয়ার ছেলে এ কে এম জামাল উদ্দিন আহমেদ (৩৬), ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মহিউদ্দিন মিয়ার ছেলে মো: সুজন মিয়া (৪৫), কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার হাবিবুর মিয়ার ছেলে মো: রাসেল মিয়া (২৪), কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার কাশেম মিয়ার ছেলে গোলাপ মিয়া (৩৪), ময়মনসিংহ নান্দাইল উপজেলার শিরু মিয়ার মেয়ে ফাতেমা (৩০), সুজন মিয়ার ছেলে সজিব (১১) ও ইসমাইল (৮), কুলিয়ারচর উপজেলার জুবায়ের (৩০), ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সুজন মিয়ার মেয়ে হুসনা আক্তার (৩০), ভৈরবের আমলাপাড়া এলাকার দর্শন মিয়ার ছেলে নজরুল (৪০), কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার পানাহার গ্রামের মৃত জালাল উদ্দিনের ছেলে মো: সফিকুল (৩৪) ও আরো একজন অজ্ঞাত (১৭)।
সোমবার রাতেই স্বজনদের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়।


আরো সংবাদ



premium cement
কুষ্টিয়ায় রেলসেতুর নিচ থেকে বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার অ্যান-মেরি ট্রেভেলিয়ানের সাথে বিএনপির বৈঠক বাংলাদেশের কোচ হতে আগ্রহী মালান সমাবেশের অনুমতি মেলেনি বিএনপির, বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা কুলাউড়ায় আ’লীগ সভাপতি ও সম্পাদককে হারিয়ে ফজলুল হক নির্বাচিত বাংলাদেশে আসছেন নেপালের প্রধান বিচারপতি সোহেল চৌধুরী হত্যা : আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন বিশ্বে বায়ু দূষণের তালিকায় ঢাকা শীর্ষে মা দিবস উপলক্ষে খালেদা জিয়ার ছবি সম্বলিত পোস্টার লাগালেন রিজভী ইসরাইলের গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে : অ্যাডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এক পাইলট নিহত

সকল