০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নতুন আঙ্গিকে সেজেছে কুয়াকাটার পর্যটনশিল্প

-

করোনা মহামারীর ধকল কাটিয়ে কুয়াকাটার পর্যটনে জেগেছে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি। এখানকার পর্যটন শিল্পে ধীরে ধীরে আবার প্রাণ ফিরছে। ইতোমধ্যে ছুটির দিনগুলোয় পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। যদিও উদ্যোক্তারা এখনো পুরোপুরি ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। দীর্ঘ লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁর মালিকসহ বিশাল একটি অংশ বর্তমানে মূলধন সঙ্কটে রয়েছেন। সরকারি উদ্যোগে স্বল্প সুদে জামানতবিহীন ঋণসুবিধা দিলে তারা আবার পূর্ণ উদ্যোমে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন বলে অভিমত তাদের। এ দিকে ছাঁটাইয়ের কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন এই শিল্পে নিয়োজিত বহু কর্মী। পুরনো চেহারা ফিরে পেতে কুয়াকাটার হোটেল-মোটেলগুলোকে সাজানো হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকাকে ঘিরে সরকারের একটি গুচ্ছ পর্যটনশিল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী কয়েক বছরে এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের চেহারা পাল্টে যাবে। আগামী ১৫ ডিসেম্বরের পর থেকে শীত মৌসুমজুড়ে পর্যটন ব্যবসা চাঙ্গা থাকবে বলে আশা করছেন স্থানীয়রা।
হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, রাখাইনদের তৈরি কাপড়, বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘিরেই মূলত কুয়াকাটার পর্যটন খাত। পর্যটকদের আগমন না থাকায় তাঁত ও হস্তশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত মানুষ আর্থিক সঙ্কটে পড়েন। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে। কুয়াকাটায় বিভিন্ন পর্যটন স্পট রয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা ১৪২টির বেশি হোটেল-মোটেল রয়েছে। পর্যটন স্পটগুলোতে সড়ক ও নৌপথে সহজে যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে।
চলতি মৌসুমের শুরুতেই কুয়াকাটার পর্যটন স্পটগুলোয় বাড়ছে কোলাহল ও কর্মচাঞ্চল্য। সৈকতের শূন্য পয়েন্ট থেকে দুই দিকে দুই কিলোমিটারজুড়ে পর্যটকে ঠাসা। কুয়াকাটার আকর্ষণীয় সমুদ্র সৈকত, সূর্যোদয় সূর্যাস্তের দৃশ্য, ইকোপার্ক, রাখাইন মার্কেট, ছায়াঘেরা নারিকেল কুঞ্জ, লেম্বুর চরের শুঁটকি পল্লী, মিশ্রিপাড়ায় অবস্থিত এশিয়ার সর্ব বৃহৎ বৌদ্ধমূর্তি, সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চলখ্যাত ফাতরার সবুজ বন, মম্বীপাড়ার সৎ সঙ্গের মন্দির, ঝাউবাগান, লেম্ফুর চর বনাঞ্চল, গঙ্গামতির লেকপাড় সর্বত্র পর্যটকের ভিড় রয়েছে।
ইলিশ পার্ক লেকের পাশে ৭২ ফুট লম্বা বিশাল ইলিশ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে এই মাত্র সাগর থেকে মাছটি ধরা হয়েছে। সূর্যের আলোতে মাছের শরীর চিকচিক করছে। প্রকৃতির আদলে সাজানো লেকের পাশে রাখা মাছটি দেখে উড়ছে সাদা বক। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় থাকে। মেঘ, রৌদ্রময় বিস্তীণ সৈকত ও সমুদ্রের মৃদু ঢেউয়ের পরশ তাদের ক্লান্তময় ভ্রমণের কিছুটা শান্তির পরশ বুলালেও অধিকাংশ সময় তাদের হোটেলে বন্দী থাকতে হচ্ছে। রাতের কুয়াকাটা এখনো অন্ধকারই থেকে গেলো পর্যটকদের কাছে। বিশাল সমুদ্রের নীল জলরাশি দোলনার মতো যখন দুলে দুলে তীরে আসতে থাকে তখন পূর্ব আকাশে সূর্যে হালকা রক্তিম বৃত্তটা ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে। তখন প্রথম সূর্যোদয়ের আলোতে আলোতিক হয়ে পাল্টে যায় কুয়াকাটার সমুদ্রের নীলাভ জল বর্ণ। লাল বর্ণ সূর্যটা অল্পক্ষণের মধ্যেই পূর্ণ বৃত্তে রূপ নেয়। এই নতুন সূর্য পুব আকাশে নিয়ে আসে এক অপরূপ শোভা। আকাশে সদ্য ওঠা সূর্য, নিচে সমুদ্রের নীল জল, সুদীর্ঘ বেলাভূমি আর পাশে ঘন সবুজ ঝাউবনের সমন্বয়ে কুয়াকাটা সৈকত ফিরে পায় অপরূপ সৌন্দর্য।
সৈকতের কোল ঘেঁষেই রাখাইন সম্প্রদায়ের কেরানিপাড়া। এখানে আছে শত বছরের পুরনো সীমা বৌদ্ধমন্দির। মন্দিরের একটু পাশেই রয়েছে কুয়াকাটার সেই ঐতিহ্যবাহী কুয়া বা ইন্দিরা। এ কুয়া থেকেই আজকের কুয়াকাটার পরিচিতি। কুয়াকাটার পাশে রয়েছে বাড়তি পাওনা হিসেবে সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চল। ফাতরার বনাঞ্চল, সোনাকাটা, ট্যাংরাগিড়ির বনাঞ্চল, ওয়াচ টাওয়ার এখন আকর্ষণীয় স্থান পর্যটকদের কাছে।
কুয়াকাটার পাশাপাশি রয়েছে সোনারচর, সোনা নেই ঠিকই কিন্তু আছে সোনার মতো বালু। সূর্যের প্রখর রোদ যখন বালুর ওপর পড়ে দূর থেকে তা দেখতে সোনার মতোই। তাই নাম সোনারচর। প্রায় ১০ হাজার একরের বিশাল বনভূমি। পটুয়াখালী বন বিভাগের তথ্য মতে, সুন্দরবনের পরেই আয়তনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল। শুধু সোনারচর নয়, পাশের রুপারচর, মৌডুবি, চরতুফানিয়া, চরকবির, চরফরিদ, শিপের চরসহ আরো কয়েকটি দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো। আরো কিছু দর্শনীয় স্থান হলোÑ কলাপাড়ার পাখিমারা এলাকায় পানি জাদুঘর, কলাপাড়ায় অবস্থিত রাডার স্টেশন ও আবহাওয়া অফিস, পায়রা সমুদ্র বন্দর এলাকা ইত্যাদি। গঙ্গামতির সুন্দর নামটিকে আরো সুন্দর করেছে এর অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য। গঙ্গামতিচর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। কুয়াকাটায় আগত পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।
কুয়াকাটায় ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে তিন তারকা মানের হোটেল-মোটেলসহ প্রায় দুই শতাধিক আধুনিক হোটেল, মোটেল ও রেস্ট হাউজ। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে ফাতরার বনাঞ্চলে ঘোরার টুরিস্ট বোর্ড সার্ভিস। রয়েছে ওয়াটার স্কুটার, স্পিডবোট সুবিধা। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরের গভীরে চর বিজয়ে দিনভর ঘুরে বেড়ানোর সুবিধা রয়েছে এখানে। স্থাপন করা হয়েছে টুরিস্ট পুলিশের একটি ইউনিট।
কুয়াকাটা টুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার জানান, করোনার কারণে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় দুই দফায় কুয়াকাটার সব পর্যটন স্পট ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। এই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ হবে না। বর্তমানে মূলধন সঙ্কটের কারণে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসে গেছে। অবশ্য কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব শরীফ জানান, আগামী ১৫ ডিসেম্বরের পর থেকে পুরো শীত মৌসুম পর্যটনব্যবসা চাঙ্গা থাকবে বলে আশা করছি। পর্যটন বিকাশে তিনি সরকারি তরফে নানা উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান। এ ছাড়া পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা, প্রাইভেসি ও স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement