২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সয়াবিন মিল রফতানি বন্ধ না হলে পোলট্রি ও গো খাদ্যের দাম বাড়বে

এফআইএবির সংবাদ সম্মেলন
-

হাঁস-মুরগি, মৎস্য ও গবাদিপশুর খাদ্য তৈরির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান সয়াবিন মিল। বাংলাদেশে বছরে ফিডমিলগুলোর এই সয়াবিন মিলের চাহিদা ১৮-২০ লাখ মেট্রিক টন। যার মধ্যে ৭৫-৮০ ভাগ দেশীয় সয়াবিন তৈল উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান থেকে এবং অবশিষ্ট ২০-২৫ ভাগ আমদানির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। বিশ্ববাজারে যখন সয়াবিন ও সয়াবিন মিল বা সয়া কেকের উচ্চ মূল্য এবং আমদানি সময় ও ব্যয়বহুল ঠিক তখন উচ্চ লাভের আশায় ভারত ও নেপালে রফতানি করছে কিছু বড় কোম্পানি। দেশীয় পোলট্রি ও মৎস্য ফিড চাহিদা মেটাতে তেল কোম্পানিগুলোকে সয়াবিন সিড আমদানিতে শুল্ক মুক্ত সুবিধা দেয়া হলেও তারা এখন অতি মুনাফায় দেশীয় চাহিদাকে অগ্রাহ্য করেই বিদেশে রফতানির সুযোগ নিয়েছে। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় এই রফতানির বিরুদ্ধে সুপারিশ করলেও কর্ণপাত করছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও ফিডমিল মালিকদের অনুরোধে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট শাখা সয়াবিন মিল রফতানি বন্ধের আদেশ প্রদান করলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একতরফাভাবে ফিড তৈরির অন্যতম উপাদান সয়াবিন মিল বা সয়াবিন কেক রফতানি অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ করেছে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (এফআইএবি)।
গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এসব তথ্য জানান সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো: আহসানুজ্জামান। এ সময় এফআইএবির সভাপতি এহতেশাম বি. শাহজাহান, সাবেক সভাপতি ও বর্তমান ইসি সদস্য সাইফুল আলম খান, ইসি সদস্য ও বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সহসভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ, এফআইএবির ইসি সদস্য, আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সাশ্রয়ী মূল্যে দেশের মানুষের জন্য ডিম, দুধ, মাছ, গোশতের উৎপাদন ও জোগান নিশ্চিত করছে দেশীয় পোলট্রি, মৎস্য ও ডেইরি খাত। সাম্প্রতিক সময়ে হাঁস-মুরগি, মৎস্য ও গবাদিপশুর খাদ্য তৈরির অত্যাবশ্যকীয় একটি উপকরণ ‘সয়াবিন মিল’ রফতানির অনুমতি প্রদান করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে খামারি ও উদ্যোক্তাদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। পোলট্রি, ডেইরি ও প্রাণিখাদ্য তৈরিতে প্রধান যে কাঁচামালগুলো ব্যবহৃত হয় তার মধ্যেÑ ভুট্টা, সয়াবিন মিল, গম, আটা, ময়দা, ভাঙা চাল, চালের কুড়া, ফিশ মিল, সরিষার খৈল, তৈল, ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি অন্যতম। এর মধ্যে দু’টি উপকরণ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়Ñ ভুট্টা ও সয়াবিন মিল। ভুট্টার ব্যবহার প্রায় ৫০-৫৫ শতাংশ এবং সয়াবিন মিলের পরিমাণ প্রায় ২৫-৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর থেকে ভুট্টার আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশীয় মোট চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ ভুট্টা দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। তবে সয়াবিনের উৎপাদন নিতান্তই নগণ্য।
মো: আহসানুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশের ফিড মিলগুলোতে ব্যবহৃত কাঁচামালের বেশির ভাগই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বর্তমানে চাহিদাকৃত সয়াবিন মিল দেশীয় সয়াবিন তৈল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও ভারত, আমেরিকা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। দেশে উৎপাদিত সয়াবিন মিলের একমাত্র ক্রেতা হচ্ছে পোলট্রি, মৎস্য, ক্যাটল ও ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ খামারিরা। সয়াবিন মিলের রফতানির সিদ্ধান্তে খামারিরা উদ্বিগ্ন। কারণ ডিম, মাছ, মুরগি উৎপাদনে মোট খরচের প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ খরচই হয় ফিড ক্রয় বাবদ। তাই ফিডের মূল্য বৃদ্ধি পেলে খামারিদের উৎপাদন খরচ বাড়ে; অন্য দিকে খরচের বিপরীতে পণ্যের নায্য দাম না পাওয়ায় বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়তে হয় তাদের।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের কথা বিবেচনায় নিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে সয়াবিন তৈল, পোলট্রি, মৎস্য ও গরুর খাদ্যের প্রধান উপাদান সয়াবিন মিলের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকার শূন্য শুল্কে বা করমুক্ত সুবিধায় সয়াবিন সিড আমদানির অনুমতি প্রদান করেছে। সয়াবিন সিড থেকে সয়াবিন তৈল বের করার পর অবশিষ্ট খৈল থেকে তৈরি হয় সয়াবিন মিল। দেশের মানুষের স্বার্থে শূন্য শুল্ক সুবিধায় আনা সেই সয়াবিন সিড থেকে উৎপাদিত সয়াবিন মিলই এখন তিন-চারটি সয়াবিন তৈল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার স্বার্থে রফতানি করছে।
অতীতে কখনো ভারতে সয়াবিন সিড কিংবা সয়াবিন মিল রফতানি হয়নি বরং ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সয়াবিন মিল আমদানি করা হয়ে থাকে। অতীতে চাহিদা মেটাতে বেশির ভাগ সয়াবিন মিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হলেও এলসি করা, অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে জটিলতা, ল্যাব টেস্টের জটিলতা, বিলম্ব মাশুল ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতার কারণে সয়াবিন মিল আমদানির পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলো ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন মিল আমদানি করতে হলে এলসি করা থেকে শুরু করে বন্দরে মাল এসে পৌঁছানো পর্যন্ত সময় লাগে প্রায় ৫০ দিন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সময় লাগে ৭০ দিন। ভারত থেকে সড়কে ৭-১০ দিন, কনটেইনারে ১৫-২০ দিন। বিশ্ববাজারে এবং সেই সাথে ভারতে সয়াবিন মিলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সে দেশের পোলট্রি, ডেইরি ও মৎস শিল্প রক্ষা করতে এবং স্বল্পতম সময়ে বাংলাদেশ থেকে সয়াবিন মিল আমদানির জন্য ভারত, নেপাল প্রভৃতি দেশের ফিড প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ বেড়েছে। আমাদের উদ্বৃত্ত থাকলে রফতানি করতে কোনো অসুবিধাই ছিল না। কিন্তু দেশের চাহিদা যখন দেশীয়ভাবে পূরণ করা যাচ্ছে না; তখন রফতানির সিদ্ধান্ত কেন?
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সয়াবিন মিল রফতানির খবরে স্থানীয় সয়াবিন মিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সয়াবিন মিলের দাম কেজিপ্রতি ১০-১২ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে; ফলে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। সয়াবিন মিলের সঙ্কটের কারণে অনেক ফিডমিলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে; উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, খামারি পর্যায়ে অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় সয়াবিন মিল রফতানি বন্ধের সুপারিশ করলেও কোনো কিছুই আমলে না নিয়ে একতরফাভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রফতানির সিদ্ধান্তে অনঢ় রয়েছে। বর্তমানে ভারত ও নেপালে সয়াবিন মিলের রফতানি চালু রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইং) সয়াবিন মিল বন্ধের আদেশ প্রদান করলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের কারণে তা পুনরায় প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বলেন, বাণিজ্য উন্মুক্ত থাকা সত্ত্বেও নিজের দেশের স্বার্থ, দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার স্বার্থে অনেক দেশই আমদানিযোগ্য বিভিন্ন পণ্যের ওপর নানা ধরনের কর ও শুল্ক আরোপ করার মাধ্যমে আমদানি নিরুৎসাহিত করে থাকে। এমনকি অনেক সময় রফতানিও বন্ধ করে দেয়। ভারতেও অভ্যন্তরীণ সঙ্কট ও মূল্য বৃদ্ধি হলে চাল, পেঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্যের রফতানি বন্ধ করে দেয়া হয়। অথচ আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অন্য দেশের শিল্পের স্বার্থে রফতানি উন্মুক্ত করে দিয়ে কার্যত দেশীয় ডিম, দুধ, মাছ, গোশত ও ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অবিলম্বে এই সয়াবিন মিল রফতানি বন্ধের দাবি জানান তিনি। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এহতেশাম বি. শাহজাহান বলেন, গত ৩০ বছরের মধ্যে এই সেক্টর কখনো এ রকম হুমকিতে পড়েনি। এমন হুমকি যে, আগামী এক বছরের মধ্যে সমাধান দেখছি না। তিনি বলেন, কোভিডের কারণে এই সেক্টরে বড় ধাক্কা লেগেছে। অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। ৩৫০টির মতো ফিডমিলের মধ্যে ৫০টির মতো বন্ধ হয়ে গেছে। পোলট্রি ও গোখাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে যেন এই সয়াবিন মিল বা কেক রফতানি করা না হয়, সরকারের কাছে এই দাবি জানাচ্ছি।


আরো সংবাদ



premium cement