২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সিয়ামের পুরস্কার আল্লাহর সন্তুষ্টি

-

মাহে রমজানুল মোবারক মুমিন বান্দাহদের যারা বছরের জীবনযাত্রায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী মাস। এ মাসে একজন মুসলমানকে নিজের সাধারণ জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও আনুগত্যে এবং তার সন্তুষ্টি অর্জনের ওপর বিশেষ জোর দিতে হয়। আল্লাহর ইবাদতে সাধনার সাথে কিছু বিধিনিষেধসহকারে পালন করতে হয় দিন রাতের কর্মসূচি। তারপর ফলস্বরূপ মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়।
এই সন্তুষ্টির একটি তাৎক্ষণিক আলামত ঈদুল ফিতরের পুরস্কার। এই ঈদকে বলা হয় ঈদুল ফিতর। এটি রোজার বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার ঈদ। এর আগের দিন পর্যন্ত ছিল রোজার বিধিনিষেধ। শাওয়াল মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার মাধ্যমে সেসব বিধিনিষেধের অবসান হলো। তবে এসব বিধিনিষেধ শাস্তি ছিল না; বরং আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের জন্য এক বিশেষ কর্মসূচি পালন করতে হয়েছে। এ নিয়মপদ্ধতি পালন ছিল সাফল্য লাভের ও উপকার লাভের জন্য। তাই এগুলো পালনে বরং আনন্দ বোধ করাই স্বাভাবিকতার দাবি। এই আনন্দই আসে ঈদের আকারে। তাই ঈদুল ফিতর নিয়ে আসে আনন্দ ও তৃপ্তির বার্তা। একই সাথে তা মুমিন বান্দাহদের মধ্যে সৃষ্টি করে আধ্যাত্মিক সাফল্য ও উন্নতির অনুভূতি এবং অতীত মাসের কার্যকলাপ পর্যালোচনার সুযোগ। আল্লাহ তায়ালার তাওফিকে সেই বিশেষ ইবাদত সম্পন্ন করার সুযোগ হয়েছে, যা আল্লাহ তায়ালার বিশেষ সন্তুষ্টি অর্জনের কারণ এবং ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এই ইবাদতটির মধ্যে রয়েছে আল্লাহ পাকের প্রতি দাসত্ব ও আনুগত্য প্রকাশের বেশ কয়েকটি দিক।
ইসলামের পাঁচ বুনিয়াদি ইবাদত বা স্তম্ভের অন্যতম রমজানের রোজা। এই পাঁচ রুকন বা স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে ইসলামের ইমারত। তাই প্রতিটি স্তম্ভেরই সুরক্ষা প্রয়োজন। তাহলেই ইসলামের ইমারত বা কাঠামো বহাল থাকবে। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হওয়ার পাশাপাশি রোজায় রয়েছে অনেক বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য। এগুলো নিয়ে মানুষ যদি সহজাত বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেকের সাথে চিন্তা করে, তাহলে তাতে সে নিজ জীবনের জন্য কয়েকটি উজ্জ্বল দিক দেখতে পাবে। উন্নত মানবীয় মূল্যবোধ চর্চার জন্য নিজের প্রবৃত্তির চাহিদা নিয়ন্ত্রণ ও নিজের চাহিদা-স্বার্থ উপেক্ষা করে আপন প্রভুর বিধান পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। রোজার মাধ্যমে মানুষ এক দিকে আধ্যাত্মিক সদগুণাবলিতে সমৃদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে। অন্য দিকে অন্যদের দুঃখ-দুর্দশা নিজের অভিজ্ঞতায় এনে নিজের মধ্যে সমবেদনা ও সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে।
সে সুবহে সাদিকের আগেই আরামের বিছানা ছেড়ে এমন সময়ে পানাহার করে, যখন পানাহারের চেয়ে বিছানায় দেহ মিলিয়ে রাখাই তার কাছে বেশি প্রিয় থাকে। তার পর নাশতার সময়ে নাশতা না করে এবং দুপুরে খাবার না খেয়েই কাটায়। বিকেল হলেও তাকে অপেক্ষা করতে হয় সূর্যের অস্ত যাওয়ার। এক মুহূর্ত আগেও খাবার বা পানীয় গ্রহণের অনুমতি নেই তার। সময় হয়ে গেলে তাকে অন্য সব জরুরি কাজ রেখে আগেই খাবার পানীয় গ্রহণ করতে হয়। এভাবে পানাহারের ক্ষেত্রে সে তার নিজের চাহিদা ও পছন্দের ক্ষমতা হারায় এবং নিজ প্রভুর ইচ্ছা ও আদেশের কাছে নিজেকে সমর্পিত করে। রোজার সময় তাকে কেবল পানাহারেই বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয় না। বরং চাহিদা ও পছন্দের আরো বেশ কয়েকটি ব্যাপারেও তাকে নিবৃত্ত থাকতে হয়। যেমন পানাহারের পাশাপাশি তাকে কামাচার থেকেও নিবৃত্ত থাকতে হয়। শুধু এতটুকু করলে আইনত তার রোজা পালিত হয় এবং সে দায়মুক্ত হয়। কিন্তু রোজার পূর্ণতা ও সার্থকতার জন্য তাকে পাপাচার থেকেও নিবৃত্ত থাকতে হয়। আলাপচারিতায় অন্যের দোষত্রুটি অনুসন্ধান এবং এ জাতীয় যেসব ব্যাপারে প্রবৃত্তি সাধারণত অবাধ থাকতে চায়, সেগুলো থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। তাকে এসব ব্যাপারে পুরোপুরি সংযমের চিন্তা জাগ্রত রাখতে হয়। পানাহারের ক্ষেত্রে তাকে যেমন সময়ের কড়াকড়ি মেনে চলতে হয়, তেমনি অন্যদের কষ্ট ও দুর্দশা অনুভব করা এবং তাদের চাহিদা পূরণ ও কষ্ট লাঘবে অংশ নেয়ার দায়িত্ববোধ থাকতে হয় তার।
এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকে পুরো এক মাস। এভাবে রমজান হয়ে দাঁড়ায় মানবতা ও আভিজাত্য এবং এক অদ্বিতীয় প্রভুর সামনে আনুগত্য ও দাসত্ব প্রকাশের অভ্যাস গড়ে তোলার মাস। এই দীক্ষা গ্রহণ ও অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে মানুষ আধ্যাত্মিক অবস্থার দিক দিয়ে পূতপবিত্র প্রকৃতি অর্জন করে। মানুষ এই আধ্যাত্মিক দীক্ষার কর্মসূচি যদি যথানিয়মে প্রতি বছর চালিয়ে যেতে থাকে, তা হলে সে প্রতি বছর মানবীয় গুণাবলির প্রতিফলনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং এসব বৈশিষ্ট্য তার উত্তরোত্তর উৎকর্ষ সাধন হতে থাকে। পুরো রমজান মাস এমন মহান, পবিত্র ও পবিত্রতা সাধনকারী কর্মসূচিতে অতিবাহিত হয়, যা মানুষকে নিজ প্রভুর দৃষ্টিতে প্রিয়পাত্র করে দেয়। আল্লাহর শেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনÑ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, মানুষ তার প্রতিটি কাজের বিনিময়ে নির্ধারিত প্রতিদানের উপযুক্ত হয়। তাকে সেই অনুযায়ী প্রতিদান দেয়া হবে। তবে রোজা ব্যতিক্রম। কেননা তা বিশেষভাবে আমার সাথে সম্পর্কিত। এটির প্রতিদানও আমি বিশেষ নিয়মে দান করব। রোজার এই বিশেষত্ব অন্য কোনো ইবাদতে নেই।
রমজান মাস অতিবাহিত হতে থাকে। আর রোজাদার উন্নতি লাভ করতে থাকে। প্রথম দশকের পর দ্বিতীয় দশকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আরো নেয়ামত ও বরকত তার জন্য বরাদ্দ হয়। তার পর শুরু হয় তৃতীয় ও শেষ দশক। এতে সে আরো বিশেষত্ব লাভ করে। এই দশকে রোজাদাররা লাভ করে সেই বিশেষ রজনী, যা অসাধারণ রহমত ও বরকতের রজনী হিসেবে আখ্যায়িত। এই রজনীটির মর্যাদা হাজার মাস অর্থাৎ ৩০ হাজার দিনের চেয়ে বেশি। কেননা এই রাতে আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীকে বিশেষ নৈকট্য দান করেন। ফেরেশতারা রুহুল কুদসের সাথে সারিবদ্ধভাবে পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং নূরানি চাদোয়ায় ঢেকে দেন। এটা লাইলাতুল কদর, যার কথা আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। এই বিশেষ নেয়ামতে ভূষিত হয় রোজাদার। সে তখন আপন প্রভুকে স্মরণ করে। তার নাম জপে। যেন সে মহান প্রভুর বিশেষ দরবারে হাজির হয়। তখন তার ইবাদত বন্দেগির গ্রহণযোগ্যতা অনেক গুণ বেড়ে যায়।
রমজানের ঊনত্রিশ বা তিরিশ দিন এমন নূরানি ভাব ও অবস্থায় অতিবাহিত করার পর আসে ঈদুল ফিতরের দিন। এই দিনটি আগমন করে আনন্দ ও ইবাদত এবং স্বস্তি ও গ্রহণযোগ্যতা উভয়কে সাথে নিয়ে। এ দিনে থাকে পার্থিব ও পরকালীন উভয় দিক দিয়ে আনন্দের সামগ্রী। এক দিকে সে লাভ করে নিজের বৈধ পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী জীবনযাপনের স্বাধীনতা। অন্য দিকে পুরো এক মাস আনুগত্য, বাধ্যতা ও ইবাদতের পুরস্কারের সিদ্ধান্ত হয় এবং তাকে রোজার পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এই হিসেবে ঈদের রাতকে লাইলাতুল জায়েজা বা পুরস্কারের রাত নামে আখ্যায়িত করা হয়। রমজানের রোজা যে ব্যক্তি যথানিয়মে পালন করে, রমজান তাকে এমন পবিত্রতা দান করে যা তার সারা বছরের জন্য বরকত ও রহমতের পাথেয় হয় এবং বছর ঘুরে আবার এই বরকতময় মাস আসে। তখন কল্যাণ ও মহিমার এ কর্মসূচি আবার পালনের সুযোগ হয়।
রমজান মাস একজন মুসলমানকে এই উপলব্ধি দান করে যে, এই পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা মানুষ হিসেবে তারই মতো। কিন্তু তাদেরকে অনাহারের কষ্ট ভোগ করতে হয়। এমন অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের কাছে মানবীয় চাহিদাগুলো পূরণের সামগ্রী নেই। রমজান আরো বলে দেয়, মানুষের উচিত তার চার পাশে বসবাসকারী ও স্বজাতির দুঃখকষ্ট অনুভব করা এবং তাদের প্রতি যথাসম্ভব সমবেদনা অনুভব করা। এ জন্য অভাবীদের সহায়তা ও ক্ষুধার্তকে আহার করানো রমজানের অত্যন্ত প্রিয় কাজগুলোর অন্তর্গত সাব্যস্ত করা হয়েছে। মানুষ যখন রোজা রেখে ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করে তখন সে নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারে ক্ষুধা কী এবং অনাহারি মানুষদের প্রতি সমবেদনা কত উন্নত আচরণ। রোজা রেখে সে যখন প্রবৃত্তির বিভিন্ন চাহিদা পূরণ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে বাধ্য হয়, তখন সে নিজেকে সেসব মন্দ কাজকর্ম থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত হওয়ার সুযোগ পায় যেগুলো উন্নত জীবনপদ্ধতির সাথে বেমানান ও নিন্দনীয়। এভাবে রমজান আসে মানুষকে সৎ, সজ্জন ও পবিত্র বানানোর কর্মসূচি নিয়ে। এই কর্মসূচি মানুষের জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এতে রয়েছে মানুষের উন্নতি ও কল্যাণের পাশাপাশি মহান প্রভুর সন্তুষ্টি ও প্রীতি লাভের ব্যবস্থা। রমজানের সিয়াম পালনের প্রথম পুরস্কার ঈদুল ফিতরের আনন্দ এবং প্রকৃত পুরস্কার মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার পক্ষ থেকে বিশেষ প্রতিদান।
অনুবাদ : মাওলানা লিয়াকত আলী


আরো সংবাদ



premium cement