২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রক্ত দিন সুস্থ থাকুন

-

শিশু আলমাস মিটফোর্ড হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে ভর্তি। প্রতি মাসে তার শরীরে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হয়। রক্ত পাওয়া নিয়ে তার অভিভাবককে কম ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয় না। দ্বারে দ্বারে ছুটতে হয় এক ব্যাগ রক্তের জন্য। কোনো মাসে রক্ত সংগ্রহ করতে বেশ কষ্ট হয়। ছেলের মুখের দিকে তাকানো যায় না এ সময়। কারো দয়া হলে এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে শিশুটির মুখে হাসি ফোটান। এই দয়ালু রক্তদাতাদের সম্মানিত করতে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ১৪ জুলাই পালন করা হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। এবারের স্লোগান জীবনের উপহার দিন : রক্তদান করুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিরাপদ রক্তপ্রাপ্তি গ্রহীতার মানবাধিকার, নিরাপদ রক্ত সংস্থান করা একটি সুযোগ। মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে রক্তের কোনো বিকল্প নেই, সড়ক দুর্ঘটনা, অপারেশন, গর্ভবতী মাদের প্রসবকালীন জটিলতায় রক্তক্ষরণ, থ্যালাসেমিয়া, লিউকেনিয়া, হেমফিলিয়াসহ বিভিন্ন রক্ত রোগের চিকিৎসায় আমাদের বছরে প্রায় পাঁচ লাখ ব্যাগ রক্ত দরকার হয়। পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের দূষিত রক্তের ওপর নির্ভরতা আজ থেকে আট বছর আগেও ছিল ৭০ শতাংশের মতো। কিন্তু জনসচেতনতা বাড়ায় এবং সরকারি নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির নানা আয়োজন ও উদ্যোগে রক্তের উৎসের এই সংস্থান বর্তমানে রোগীর আত্মীয়স্বজন (৬০ শতাংশ), স্বেচ্ছা রক্তদাতা (৩০ শতাংশ) ও ১০ শতাংশ পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের রক্তে। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মতে, রক্তগ্রহীতার জন্য নিরাপদ রক্ত/উপাদানের সংস্থান করতে হবে সহজলভ্যভাবে, সস্তায় ও হোলব্লাডের সমন্বিত ও যৌক্তিক ব্যবহারের মাধ্যমে। এই লক্ষ্যে কৌশল হিসেবে, শতভাগ স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে, পাঁচটি রক্তবাহিত ঘাতক রোগের (হেপাটাইটিস বি এবং সি, এইডস, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়া) স্ক্রিনিং করে, কমপোনেন্ট থেরাপি প্র্যাকটিসের মাধ্যমে রক্তের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে।
পরিসঞ্চালন চিকিৎসা পদ্ধতির মূল ভিত্তি হলো একজন রক্তদাতা। রক্তদাতা যদি না থাকে, রক্ত সঞ্চালন সম্ভব হবে না বা করা যাবে না। রক্ত সংগ্রহ করতে না পারলে কিসের স্ক্রিনিং আর কিসের কমপোনেন্টাইজেশান আর কিসের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। আসুন পাঠক আমরা ডোনার এবং তার প্রকারভেদ রক্তদান ও তার উপকারিতা রক্তদানের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে আগে অবহিত হই, তার পর সিদ্ধান্ত নেই কেন রক্ত দেবো, কী উপকার হবে নিজের ও সমাজের সর্বোপরি নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আন্দোলনে আমাদের কার কী ভূমিকা হওয়া উচিত।
কম ঝুঁকিপূর্ণ রক্তদাতা
আপাত সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক (১৮-৬০ বছর), উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী, পরোপকারী মানসিকতাসম্পন্ন, আগ্রহী, শিক্ষিত সচেতন ব্যক্তিবর্গ, নিরোগ দেহের প্রণোদিত ব্যক্তিবর্গ (ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, গৃহিণী, চাকরিজীবীরা), ধর্মীয় অনুশাসনে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ব্যক্তিরা।
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রক্তদাতা
পেশাদার রক্ত বিক্রেতা, বাণিজ্যিক যৌনকর্মী, শিরায় মাদকাসক্ত ব্যক্তি, দূরগামী ট্রাকচালক/নাবিক, প্রবাসী/ভ্রমণকারী অবাধ যৌনাচারী, এইডস অধ্যুষিত দেশের অধিবাসী, অনিরীক্ষিত রক্ত পরিসঞ্চালন গ্রহণকারী অবাধ, অনৈতিক/অরক্ষিত যৌনাচারী/বহুগামী
উপযুক্ত রক্তদাতা নির্বাচন পদ্ধতি
একজন আপাত সুস্থ ও উপয্ক্তু রক্তদাতাকে কম ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী থেকে বাছাই করা হয়। হেপাটাইটিসে আক্রান্ত, স্ক্রিনিং পরীক্ষায় রিয়েকটিভ ফলাফল সংবলিত রক্ত, শিরায় মাদকাসক্তি গ্রহণকারী রক্তদাতা, বিগত ছয় মাসের মধ্যে টাট্টু/আকুপাংচার/চর্মরোগ, রক্ত দেয়া হয়েছে এমন, তিন বছরের মধ্যে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে এমন, এইডস অধ্যুষিত দেশে ভ্রমণ বা বসবাস করেন, সাম্প্রতিক টীকা দিয়েছেন, গত ২ সপ্তাহে দাঁত উঠানো বা মুখে সার্জারি, ক্যান্সার জাতীয় অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
কখনোই যারা রক্ত দিতে পারবেন না
থ্যালাসেমিয়ার রোগী, লিউকেমিয়ার রোগী, হাইপোপ্লাস্টিক এনিমিয়া, হেমোফিলিয়া, হৃদরোগ, স্নায়ুবিক রোগ, থাইরোটকসিকোসিস, এমফাইসেমা, ইনসুলিননির্ভর (টাইপ-১) ডায়াবেটিস।
রক্তদানের ফলে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যার কারণ হলো, ৪-৬ ঘণ্টার অভুক্তি, ক্লান্তি বা অবসন্নতা, হইচই, হট্টগোল, মানুষের ভিড়, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা, অত্যধিক ঠাণ্ডা/গরম, দুশ্চিন্তা, ভয়, আতঙ্ক/আশঙ্কা অন্য ডোনারের দেখাদেখি ফিটলাগা
এ সমস্যা সমাধানে বাড়তি মনোযোগ দিয়ে মানসিক চাপ নিরসন, যতœ নেয়া ও ভালো ব্যবহার/সেবা, তরল খাবার দিয়ে আপ্যায়ন, দুশ্চিন্তা দূরীকরণে ভূমিকা রাখা, বিশ্রাম, আশ্বাস প্রদান, পায়ের দিক উত্তোলন করা, শান্ত, নীরব, অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকায় স্থানান্তরকরণ, কপালে, চোখে মুখে ঠাণ্ডা পানির ছিটা দেয়া।
রক্তদানের উপকারিতা
পেশাদার রক্ত বিক্রেতা নির্ভরশীলতা কমবে। লাল রক্তের কালো ব্যবসা কমবে, ঘাতক রোগের বিস্তার কমবে, সামাজিক সম্প্রীতি এবং বন্ধন বাড়বে। হৃদরোগ,স্ট্রোক কমবে, ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমবে, বার্ধক্য প্রক্রিয়া থমকে যাবে, নিখরচায় স্বাস্থ্য চেকআপ, পরামর্শ/চিকিৎসাপ্রাপ্তির সুযোগ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রক্ত পরিসঞ্চালন ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement