২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়

-

স্ট্রোক একটি মারাত্মক রোগ। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ এটি। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ১২ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। বিশ্বে বর্তমানে ১০১ মিলিয়ন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে জীবনযাপন করছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এ হার প্রায় ৮০ গুণ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশেও এ হার কিন্তু কম নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি এক হাজার জনে প্রায় ১২ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। স্ট্রোকে মারা যাওয়াদের দুই-তৃতীয়াংশ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের দেশে হয়ে থাকে।

স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কের রোগ মানে মস্তিষ্কের রক্তনালীর রোগ। মস্তিকের রক্তনালীতে রক্ত চলাচল কমে গেলে বা রক্তনালী ছিঁড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হলে স্ট্রোক হয়ে থাকে। সে হিসেবে স্ট্রোককে দুইভাবে ভাগ করা যায়- ১. ইসকেমিক স্ট্রোক ও ২. হেমোরেজিক স্ট্রোক।
ইসকেমিক স্ট্রোক হলে রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধে। ফলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যায়। এক সময় মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হয়ে যায়। শুরুতে কোষগুলো রক্ত চলাচল কমে গেলেও বেঁচে থাকতে পারে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর কোষগুলো মারা যায়। একে বলে কোর। কোরের চারপাশে মস্তিষ্কের বেশ কিছু অংশেও রক্ত কমে যায়। একে বলে প্যানামব্রা। যদি প্যানামব্রা অংশে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা যায় তাহলে স্ট্রোকের ভয়াবহতা অনেকটা কমানো যায়।

হেমোরেজিক স্ট্রোক- মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিঁড়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। রক্তনালীর এভিএম বা আর্টেরিওভেনাস ম্যালফরমেশন, রক্তনালীর ফোস্কা বা এনিউরিজম, রক্তনালীর ফিস্টুলা হলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
সম্প্রতি ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের ৩২টি দেশের মানুষ নিয়ে এ গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে বলা হয়েছে, মাত্র ১০টি কারণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ৯০ শতাংশ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়। তাদের মতে এ ১০টি হলো- ১. উচ্চ রক্তচাপ, ২. ডায়াবেটিস, ৩. রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, ৪. স্থূলতা, ৫. ধূমপান, ৬. মদ্যপান, ৭. হার্টের রোগ, ৮. শারীরিক পরিশ্রম না করা, ৯. মানসিক অবসাদ, ১০. সঠিক খাদ্যাভ্যাস না মানা।
এ কারণগুলো কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আরো কিছু কারণ আছে যেগুলোর জন্যও স্ট্রোক হতে পারে। যেমন- বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকি বাড়ে, পুরুষদের ঝুঁঁকি বেশি, বংশে কাছের আত্মীয়দের স্ট্রোকের ইতিহাস থাকলে ঝুঁঁকি বাড়ে। রক্তনালীর সমস্যা যেমন রক্তনালীতে ফোস্কা বা এনিউরিজম বা এভিএম বা রক্তনালী অস্বাভাবিক কমিউনিকেশনের জন্যও স্ট্রোক হতে পারে।

স্ট্রোকের আছে চিকিৎসা
হার্ট অ্যাটাক হলে আমরা রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেই। হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীতে রক্ত জমে গেলে হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। ফলে হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশি নষ্ট হয়ে যায়। একেই বলে হার্ট অ্যাটাক। হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত নিশ্চিত হওয়ার পর চিকিৎসক হার্টের রক্তনালীতে জমাট বাঁধা রক্ত গলিয়ে ফেলতে এক ধরনের ওষুধ শিরাপথে দিয়ে থাকেন। একে বলে স্ট্রেপ্টোটোকাইনেজ।
একই রকমভাবে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধলে জমাট বাঁধা রক্ত গলিয়ে ফেলতে এক ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। মস্তিষ্কের স্ট্রোকে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় তাকে বলে এল্টিপ্লেজ।

যাদের রক্তনালী রক্ত জমে বন্ধ হয়ে যায় যাকে ইস্কেমিক স্ট্রোক বলে। তাদেরকে এল্টিপ্লেজ দেয়া যায়। আবার সব ইস্কেমিক স্ট্রোক রোগীকে এ চিকিৎসা দেয়া যায় না। তো কাদের দেয়া যায়? উত্তরে আমরা বলি-
১. যাদের ইস্কেমিক স্ট্রোক হয় এবং উপসর্গ দেখা দেয়ার সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি হাসপাতালে আসেন তাহলে দেয়া যায়।
২. অনেকের ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক হয়। তাদের তো সময় মাপা সম্ভব হয় না। তাদের ক্ষেত্রে এমআরআই পরীক্ষা করে দেখতে হয় এ চিকিৎসা দেয়া যাবে কি না। যদি এমআরআই পরীক্ষা সন্তোষজনক হয় তাহলে এ চিকিৎসা দেয়া যায়
৩. বয়স ১৮ বছরের বেশি হতে হবে।

১৯৯৬ সালে এফডিএ স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা হিসেবে এল্টিপ্লেজের অনুমোদন দেয়। তখন থেকেই বিশ্বব্যাপী স্ট্রোকের চিকিৎসা হিসেবে আইভি থ্রোম্বলাইসিস ব্যবহার করা হচ্ছে। আধুনিক এ চিকিৎসার ফলাফল কিন্তু বেশ আশাব্যঞ্জক। গবেষণায় দেখা গেছে এ চিকিৎসা পাওয়া রোগীদের ৭০ শতাংশের উন্নতি হয়। আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের আইভি থ্রোম্বলাইসিস করা হয়েছে তিন মাস পর এদের ৫০ শতাংশ ব্যক্তি নিজের কাজ নিজেই করতে পারেন, ১৫ শতাংশ অন্যের কিছু সাহায্য দরকার হয়, ১৫ শতাংশ অন্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হন ও ২০ শতাংশ মারা যান।
কাজেই প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। এ সংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি। স্ট্রোকের চিকিৎসা নেই তা কিন্তু আর ঠিক নয়। স্ট্রোক হলেই যে অন্যের ওপর বোঝা হবেন তাও ঠিক না।

মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি-স্ট্রোক অত্যাধুনিক চিকিৎসা
ইস্কেমিক স্ট্রোকের রোগী সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে আসলে তাদের এল্টিপ্লেজ দিয়ে আইভি থ্রোম্বোলাইসিস করা যায়। কিন্তু এ সময়ের পরে আসলে কি আর চিকিৎসা নেই? না, চিকিৎসা আছে। স্ট্রোকের ৬ ঘণ্টার মধ্যে আসলে অত্যাধুনিক চিকিৎসা করা সম্ভব। এর নাম হলো মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি। রোগীকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে হার্টের এনজিওগ্রামের মতো ব্রেনের এনজিওগ্রাম করা হয়। যদি তাতে দেখা যায় মস্তিষ্কের মোটা রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধেছে তাহলে একটি বিশেষ সাহায্যে জমাট বাঁধা রক্ত টেনে বের করে আনা হয়। ফলে বন্ধ রক্তনালী খুলে যায়। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়। ৭০ শতাংশ রোগী এতে সুস্থ হয়ে যান। আমাদের দেশেও এ চিকিৎসা অল্প-বিস্তর হচ্ছে।

স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয়
৯০ শতাংশ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়। স্ট্রোকের মূল কারণগুলো প্রতিরোধ করতে পারলে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়।

১. ধূমপান ও মদ্যপানে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান করলে স্ট্রোকের ঝুঁঁকি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।

২. রক্তচাপ স্বাভাবিকের মধ্যে রাখুন। এ জন্য অতিরিক্ত লবণ পরিহার করুন, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন।

৩. হার্ট অ্যাটাক, অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন, হার্ট বড় হয়ে গেলে, ভাল্বের সমস্যা ইত্যাদি কারণে রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। তাই এ রোগগুলোর চিকিৎসা করান।

৪. গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে স্ট্রোকের ঝুঁঁকি কমে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ সেবন ও জীবনযাত্রা মানের পরিবর্তন করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করুন।

৫. পুষ্টিকর খাবার খান : প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল খান। প্রতিদিনের খাবারে ৫ ভাগের এক ভাগ ফলমূল ও শাকসবজি খান। রেড মিট যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়ার গোশত খাবেন না। চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করুন। এতে বেশি স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যেটি ধমনিতে চর্বির আস্তরণ পড়তে সহায়তা করে। লবণ রক্তচাপ বাড়ায়। লবণ খাবেন না। আঁশযুক্ত খাবার বেশি বেশি করে খান।

৫. কমিয়ে ফেলুন শরীরের অতিরিক্ত ওজন।

৬. নিয়মিত ব্য্যয়াম করুন। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন ব্যায়াম করে তাদের রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রেখে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। হাঁটা ভালো ব্যায়াম। হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় মেনে হাঁটুন। সপ্তাহে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ মাইল হাঁটুন।

৭. মানসিক চাপ কমান : রাগ কমান, কমিয়ে ফেলুন মানসিক চাপ। জোর করে হলেও হাসুন প্রাণ খুলে। মেডিটেশন করতে পারেন। এতে কমবে মানসিক চাপ, বাড়বে আত্মবিশ্বাস।

৮. রক্তে কোলেস্টেরল কমিয়ে ফেলুন : রক্তে কোলেস্টেরল বেশি হলে রক্তনালীতে চর্বি জমে রক্তনালী বন্ধ হয়। নিয়ন্ত্রণে রাখুন কোলেস্টেরলের মাত্রা।

লেখক : স্ট্রোক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস)


আরো সংবাদ



premium cement