২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


চোখের পাতায় খুশকি ও ব্লেফারাইটিস

-

মাথায় যেমন খুশকি থাকে চোখেও তেমনি খুশকি হতে পারে। এটি আসলে ত্বকের এক ধরনের সমস্যা। ত্বকের উপরি ভাগে দুই ধরনের গ্রন্থি থাকে। এক ধরনের গ্রন্থি আছে যাদের কাজ হলো ঘাম নিঃসৃত করা। এদের বলা হয় সুইট গ্লেন্ড। এ ছাড়া এক ধরনের গ্রন্থি আছে যার কাজ হলো তৈলাক্ত নিঃসৃত করে ত্বককে মসৃণ রাখা। এদের বলা হয় সেবাসিয়াস গ্লেন্ড। সেবাসিয়াস গ্লেন্ড পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান থাকে মাথা, মুখমণ্ডল ও চোখের পাতায়।

খুশকি : তৈলাক্ত ত্বক যেটি মাথা ও মুখমণ্ডলে আছে সেখানে এক ধরনের ঈষ্ট বা ফাঙ্গাস থাকে যেগুলোর প্রতি কারো কারো ত্বকের এক ধরনের সংবেদনশীলতা কাজ করে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে যখন বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে তখন এক ধরনের প্রদাহের সৃষ্টি হয়। এতে লালচে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং ত্বকের উপরি ভাগ খসে পড়ে। খসে পড়া সাদা দৃশ্যমান বস্তুটিই খুশকি। স্ট্রেস ও হরমোনের সমস্যা এতে ভূমিকা রাখে।
চোখে খুশকির প্রতিক্রিয়া : খুশকি দুইভাবে পাতায় সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। এলার্জির-খুশকি সরাসরি এলার্জির কারণ হতে পারে। প্রদাহ বা ব্লেফারাইটিস-খুশকি প্রায়ই পাতার কিনারায় বা পাপড়ির গোড়ায় সংশ্লিষ্ট গ্রন্থির মুখগুলোকে বন্ধ করে দিতে পারে। ফলে গ্রন্থি থেকে নিঃসরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। চোখের পাতার কিনারায় দুই ধরনের গ্রন্থি বিদ্যমান। একটি হলো সৃইট গ্লেন্ড ও অন্যটি হলো মেবোমিয়ান গ্লেন্ড। মেবোমিয়ান গ্লেন্ডের কাজ হলো তৈলাক্ত নিঃসৃত করা। তৈলাক্ত বস্তু বা সেবাম নিঃসরণ বন্ধ হলে সেবাম গ্রন্থিতে জমা হয়ে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে এখানে এক ধরনের প্রদাহ পরিলক্ষিত হয়। এটিই ব্লেফারাইটিস।

খুশকি ছাড়াও অন্যান্য কারণে ব্লেফারাইটিস হতে পারে। কসমেটিক, কন্টাক্ট লেন্স সলিউশন বা কোনো ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াতেও ব্লেফারাইটিস হতে পারে। এ ছাড়া কারো কারো বেলায় সেবামের ঘনত্বের কারণে ব্লেফারাইটিসকে উসকে দিয়ে থাকে।
উপসর্গ : চোখে জ্বালাপোড়া, চোখ লাল, পাতা ফোলে যাওয়া, পাপড়ির গোড়ায় খুশকির মতো হওয়া, পানি ঝরা, চোখে চুলকানি, পাপড়ির গোড়ায় ক্রাস্ট বা শক্ত ময়লা বিশেষ আটকে থাকা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে ।
খুশকির দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা- দীর্ঘদিন যাবৎ চোখের পাতায় এই খুশকির প্রবণতা বা ব্লেফারাইটিসের সমস্যা বিদ্যমান থাকলে চোখের পাতায় দু’টি সমস্যা প্রায়ই দেখা দেয়। একটি হলো স্টাই ও অন্যটি হলো কেলাজিয়ন। সাধারণভাবে এটি অঞ্জনি হিসেবে বেশ পরিচিত।
স্টাই : পাপড়ির গোড়ায় সন্নিবেশিত গ্রন্থিগুলোতে অনেক সময় প্রদাহ হতে দেখা যায়। বিশেষ করে স্টেফাইলোক্কাস জাতীয় ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ এখানে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রদাহের ফলে চোখের পাপড়ি সংশ্লিষ্ট গ্রন্থির নিঃসরণ ব্যাহত হয় এবং প্রদাহের ফলে উক্ত জায়গাটি ফুলে যায়। এটিই স্টাই।

উপসর্গ : ১. চোখের পাতার প্রান্তে বিশেষ করে পাপড়ির গোড়ায় ছোট ছোট ফুসকুড়ির মতো দেখা দেয়। ২. ব্যথা থাকে এবং স্পর্শ করলে ব্যথা অনুভূত হয়। ৩. অনেক সময় লালচে ভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় প্রদাহটি সম্পূর্ণ পাতায় ছড়িয়ে যেতে পারে। এটিকে বলা হয় সেলুলাইটিস। সে ক্ষেত্রে চোখের পাতা ফোলে চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে এবং তীব্র ব্যথা এমনকি জ্বর চলে আসতে পারে।
কেলাজিয়ন : এখানে মেবোমিয়ান গ্রন্থি আক্রান্ত হয়ে থাকে। কোনো কারণে মেবোমিয়ান গ্রন্থির মুখ যেগুলো পাপড়ির ফাঁকে ফাঁকে নেত্রপল্লবের ধার বা কিনারায় উন্মুক্ত থাকে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলে তখন তৈলজাতীয় নিঃসরণটি আর নিঃসৃত হতে পারে না। ফলে লিপিড বা তৈলাক্ত বস্তু গ্রন্থিতে জমা হতে থাকে এবং এই জমাকৃত লিপিড বা তৈলাক্ত বস্তুই এক ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি করে। ফলে মেবোমিয়ান গ্রন্থি ফুলে যায় এটিই কেলাজিয়ন। সাধারণত যাদের তৈলাক্ত ত্বক তাদের ক্ষেত্রে কেলাজিয়ন বেশি পরিলক্ষিত হয়।
উপসর্গ : এতে উপসর্গ তেমন একটা থাকে না। কেবল ছোট গোটার মতো ফোলাভাব বিরাজ করে। এটি সাধারণত চোখের প্রান্ত থেকে একটু দূরে থাকতে দেখা যায় । স্টাই এর সাথে কেলাজিয়নের পার্থক্য হলো এটিতে ব্যথা কম থাকে; চোখের পাতায় তেমন একটা লাল ভাব থাকে না; উপরন্তু এটি একটু দীর্ঘ মেয়াদি হয়ে থাকে। স্টাই যেখানে বিনা চিকিৎসায় ও বেশির ভাগ সময় কয়েক দিনেই সেড়ে যায় সেখানে কেলাজিয়ন মাসের পর মাস একই রকম থাকতে পারে ।

বারবার অঞ্জলি কেন হয় : ক. এলার্জিজনিত সমস্যা বা ব্লেফারাইটিস। খ. খুশকিজনিত সমস্যা । গ. ত্বকের কিছু সমস্যা যেমন একনি, রসাসিয়া ইত্যাদি। ঘ. রিফ্রেক্টিভ এরর বা দৃষ্টি সমস্যা। ঙ. রাত জেগে কাজ করা বিশেষ করে ডিজিটাল স্ক্রিনে বেশি থাকা । চ. তৈলাক্ত ত্বকে এদের প্রাদুর্ভাব বেশি । হরমোন এতে ভূমিকা রাখে।
চিকিৎসা : স্টাই হলে- ১. চোখে এন্টিবায়োটিক ড্রপ দিতে হবে। বাজারে প্রচলিত যেকোনো একটি এন্টিবায়োটিক ড্রপ ডোজ মেনে ব্যবহার করতে হবে। সিপ্রোফ্লক্সাসিন, মক্সিফ্লক্সাসিন ইত্যাদি যেকোনো একটি ব্যবহার করলেই হবে। ২. সেলুলাইটিসের মতো হলে এন্টিবায়োটিক খেতে হবে। সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এজিথ্রোমাইসিন ইত্যাদি যেকোনো একটি সেবন করলেই হবে। ৩. কেলাজিয়নে ওষুধ তেমন একটা কাজ করে না। তবে অনেক সময় স্টেরোয়েড বা সাইপোরিন জাতীয় ড্রপ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা হলো অপারেশন। অপারেশন বলতে চোখের পাতার ভেতর দিকে একটি ইনসিসন দিয়ে ভেতরে জমা হওয়া তৈলাক্ত বস্তু বা সেবাম বের করে দিতে হয়। এটিকে বলা হয় ‘ইনসিসন অ্যান্ড কিউরেটেজ’। এতে চোখের পাতা ইনজেকশনের মাধ্যমে অবস করে নিতে হয়।
অন্যান্য করণীয় : ক. চোখের পাতার হাইজিন বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা :গরম স্যাঁক- চোখের পাতায় হালকা গরম স্যাঁক খুবই কার্যকরী। হালকা গরম পানিতে পরিষ্কার কাপড় ভিজিয়ে চিপে চোখের পাতা বন্ধ রেখে পাতার ওপরে কয়েক মিনিট ধরে রাখতে হবে। এভাবে দিনে এক বা একাধিকবার স্যাঁক দিতে হবে। এতে দু’টি কাজ হবে। প্রথমত পাপড়ির গোড়ায় যেসব ক্রাস্ট থাকে সেগুলো নরম হয়ে যায় এবং আঙুলের বা কাপড়ের সাহায্যে ঘষে পরিষ্কার করে ফেলা যায়। দ্বিতীয় কাজটি হয় অত্যধিক ঘন তৈলাক্ততা দূরীভূত হয়ে গ্রন্থির মুখ খোলে যায়। এতে স্বাভাবিক গ্রন্থির নিঃসরণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

চোখের পাতা শ্যাম্পু করা- চোখে জ্বালাপোড়া করে না এমন শ্যাম্পু দিয়ে পাপড়ির গোড়া পরিষ্কার করা সপ্তাহে অন্তত দুই দিন। বেবি শ্যাম্পু বা টিটিও (টিট্রিওয়েল) শ্যাম্পু বাজারে পাওয়া যায়, যা দিয়ে খুব সহজে চোখের পাতা পরিষ্কার কাজে ব্যবহার করা যায়। আঙুলে বা কটন বাড দিয়ে পাতার গোড়ায় শ্যাম্পু লাগিয়ে একটু হালকা ম্যাসাজ বা রাব করে ধুয়ে ফেলতে হয়। এতে পাতার গোড়া পরিষ্কার থাকে এবং সহজেই মেবোমিয়ান গ্রন্থি থেকে স্বাভাবিক নিঃসরণ অব্যাহত থাকে।
খ. রিফ্রেক্টিভ এরর বা দৃষ্টি সমস্যা থাকলে দৃষ্টি পরীক্ষা যথাযথ পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করা।
গ. রাত জেগে কাজ করার অভ্যাস পরিত্যাগ করা।
ঘ. মাথায় খুশকি থাকলে নিয়মিত এন্টি ডেন্ড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহারে খুশকি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
লেখক : এমবিবিএস, এফসিপিএস (চক্ষু), এমএস (চক্ষু)
চক্ষবিশেষজ্ঞ ও সার্জন; সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল
কনসাল্ট্যান্ট- আইডিয়াল আই কেয়ার সেন্টার
৩৮/৩-৪, রিং রোড, আদাবর, ঢাকা
কনটাক্ট- ০১৯২০৯৬২৫১২


আরো সংবাদ



premium cement