২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ডায়াবেটিসজনিত চোখের সমস্যা এড়াতে

ডায়াবেটিসজনিত চোখের সমস্যা এড়াতে -


ডায়াবেটিসে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায়। রক্তে বিদ্যমান অতিরিক্ত সুগার রক্তনালীর গায়ে এক ধরনের ক্ষতের সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলো হলো এর প্রধান টার্গেট। ফলে সূক্ষ্ম রক্তনালী বিদ্যমান এমন অঙ্গগুলো যেমন- চোখ, মস্তিষ্ক, হার্ট, কিডনি সহজেই আক্রান্ত হয়ে থাকে। রেটিনার রক্তনালীর ক্ষতজনিত যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় রেটিনোপ্যাথি। এ ছাড়াও আরো একটি অন্যতম সমস্যা দেখা দিতে পারে ডায়াবেটিসের কারণে সেটি হলো ছানি। গ্লুকোমাতেও ডায়াবেটিসের প্রভাব কাজ করে । তবে ডায়াবেটিস সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে রেটিনোপ্যাথির ক্ষেত্রে।

রেটিনা যেহেতু সর্বক্ষণ আলোর সাথে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত থাকে তাই এখানে প্রচুর অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। অক্সিজেন ফুয়েল হিসেবে বার্ন হয়ে প্রচুর শক্তি উৎপাদনের পাশাপাশি কিছু বর্জ্যও উৎপাদন করে থাকে। এগুলোকে বলা হয় ফ্রি রেডিক্যাল। ফ্রি রেডিক্যাল দ্রুত নিষ্কাশিত না হলে সাধারণ কোষে ক্ষত সৃষ্টি করে। ফ্রি রেডিক্যালজনিত এই ক্ষতকে বলা হয় ফ্রি রেডিক্যাল ইনজুরি বা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হলো দেহের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দেহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই ক্ষত আবার সেরেও যায়। রক্তে সুগারের মাত্রা বেশি থাকলে তখন এই ক্ষত সেরে যাওয়ার বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। ফলে ক্ষত এক সময় স্থায়ীরূপ লাভ করে। ক্ষত রক্তনালী থেকে জলীয় অংশ খুব সহজে বের হয়ে রক্তনালীর বাইরে রেটিনাতে জমা হতে থাকে। এটিকে বলে ইডিমা বা এক্সোডেট। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা দেখা দেয়। এটিই রেটিনোপ্যাথি। একবার রেটিনোপ্যাথির সমস্যা দেখা দিলে এটি আর সাবেক অবস্থায় ফিরে যায় না। তাই রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।

ডায়াবেটিস হলেই রেটিনোপ্যাথি হবে বিষয়টি এমন নয়। রেটিনোপ্যাথির জন্য কিছু রিস্ক ফেক্টরকে দায়ী করা হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়টি এখানে উল্লেখ করা হলো-
দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস; অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস; উচ্চরক্তচাপ; হাইপার লিপিডেমিয়া বা উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল বিশেষ করে উচ্চমাত্রার এলডিএল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড; গর্ভাবস্থা; ধূমপান ইত্যাদি বিষয়গুলো ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিকে অনেকটা অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। তাই অন্ধত্য প্রতিরোধে খুবই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলোর প্রতি যতœবান হলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ও এর জটিলতা অনেকাংশেই পরিহার করা সম্ভব। প্রাথমিকভাবে রক্তে সুগার, উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি।
আর এই তিনটি কাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে করতে হলে প্রয়োজন দৈনন্দিন জীবন যাপনে শৃঙ্খলা আনয়ন। সবার আগে নজর দিতে হবে খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে।

১. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন : সুগার, লবণ ও তৈলাক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবারের আশেপাশে না যাওয়াই উত্তম। বাড়তি লবণ পরিহার করতে হবে। আঁশসমৃদ্ধ খাবার যেমন- ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি দেহের ওজন কমাতে ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এ ছাড়াও আঁশযুক্ত খাবার সুগার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি খাদ্যনালীতে কোলেস্টেরলকে রক্তে প্রবেশে বাধা দান করে। এভাবে আঁশযুক্ত খাবার ৫০-৭৫ শতাংশ কোলেস্টেরলকে মলের সাথে বের করে দিয়ে রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সরাসরি ভূমিকা রাখে। কম আঁশযুক্ত বা আঁশহীন খাবার দ্রুত রক্তে সুগারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় বিধায় এ সব খাবার যেমন- চিনি, মিষ্টি, পেস্ট্রি, পাস্তা, ময়দার রুটি, ফলের রস, ব্যাকারি ফুড ইত্যাদি পরিহার করা উত্তম। আস্ত ফলে সুগার কিছুটা থাকলেও সাথে যথেষ্ট পরিমাণ আঁশ থাকে। ফলের রসের চেয়ে সম্পূর্ণ ফল খাওয়া বহুগুণে স্বাস্থ্যকর।

খাদ্যতালিকায় ফ্যাটজাতীয় খাবার থাকতে হবে মোট ক্যালরির এক-তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ কায়িক পরিশ্রম করেন না এমন একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনন্দিন চাহিদা এক হাজার ৫০০ ক্যালরি হলে এক হাজার ক্যালরি নিতে হবে শর্করাজাতীয় খাবার (ভাত, আলু, আটার রুটি) থেকে এবং বাকি ৫০০ ক্যালরি নিতে হবে ফ্যাট থেকে। অর্থাৎ প্রায় ৬০ গ্রাম ফ্যাট প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অবশ্যই থাকতে হবে। ফ্যাটের মধ্যে আনসেচুরেটেড ফ্যাট বা ভালো ফ্যাট বলতে বাদাম, মাছের ফ্যাট, অলিভ ওয়েল ইত্যাদিকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং সেচুরেটেড ফ্যাট বা খারাপ ফ্যাট যেমন- গোশত, দুগ্ধজাত খাবার কম খাওয়া উচিত। সহজ করে বললে খাবারে অর্ধেক ফলমূল ও শাকসবজি, এক-চতুর্থাংশ হোল গ্রেইন (কর্ন, ভাত, ওট, বার্লি ইত্যাদি) এবং এক-চতুর্থাংশ আমিষ জাতীয় যেমন- লেগুম (শিমের বিচি, ডাল, পেঁয়াজ, বাদাম), মাছ বা সাদা গোশত (মুরগির গোশত)।

২. নিয়মিত ব্যয়াম : দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যয়াম খুবই প্রয়োজন। মধ্যম মানের ব্যয়াম যেমন- হাঁটাহাঁটি বা সাইকেল চালানো সপ্তাহে ১৫০ মিনিট। উত্তম প্রতিদিন ৩০ মিনিট মডারেট এক্সারসাইজ (দ্রুত হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং বা সাঁতার কাটা ইত্যাদি)। রেজিস্টেন্স এক্সারসাইজ- সপ্তাহে দুই-তিনবার যেমন ভারোত্তলন বা ইয়োগা কর্মক্ষম থাকতে সাহায্য করে। নিয়মিত ব্যয়াম মানে ভালো ঘুম। ভালো ঘুম সার্বিকভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

৩. স্ট্রেস কমাতে হবে: স্ট্রেস কমানোর রাস্তা হলো নিয়মিত ব্যয়াম, ভালো ঘুম আর দিনের কাজ গুছিয়ে করা এবং ঝামেলামুক্ত থাকার চেষ্টা করা।

৪. নিয়মিত ওষুধ সেবন ও ফলোআপ : বছরে অন্তত একবার এবং সমস্যা থাকলে আরো ঘনঘন ফলোআপে থাকতে হবে।
সাধারণের জন্য প্রাথমিক কাজ ডায়াবেটিস থেকে বেঁচে থাকার জন্য লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন আনা। ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ও অন্যান্য জটিলতা প্রতিরোধ করতে লাইফ স্টাইলে যতœবান হওয়া। সর্বোপরি চোখে সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া।

লেখক : এমবিবিএস, এফসিপিএস (চক্ষু), এমএস (চক্ষু), চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও সার্জন
সহযোগী অধ্যাপক (অফথ্যালমোলজি)
কনসালটেন্ট, আইডিয়াল আই কেয়ার সেন্টার
৩৮/৩-৪ রিং রোড, আদাবর, ঢাকা।
০১৯২০৯৬২৫১২


আরো সংবাদ



premium cement