২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ত্রাণের লাইনে গুলি চালিয়ে আরো ১৯ ফিলিস্তিনিকে হত্যা

-

- যুদ্ধবিরতি নিয়ে একমত হতে পারেনি হামাস ও ইসরাইল
- হামাসের সঙ্গে চুক্তির দাবিতে ইসরাইলে বিক্ষোভ

গাজার খান ইউনিসের আল-আমাল হাসপাতালে ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এক স্বেচ্ছাসেবী নিহত হয়েছে। শনিবার আবারো ত্রাণের জন্য অপেক্ষারত ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী। যুদ্ধবিরতি আলোচনা নিয়ে একমত হতে পারেননি হামাস ও ইসরাইলি প্রতিনিধিরা। আলজাজিরা ও আনাদোলু।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, গাজার দক্ষিণাঞ্চলের আল-কুয়েত গোলচত্বরে অপেক্ষা করছিল ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা। তাদের ভিড়ের মধ্যেই ভারী অস্ত্র ও বন্দুক দিয়ে অবিরাম গুলি চালায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী। এতে অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছে। আহত কমপক্ষে ২৩ জন। শনিবার এক বিবৃতিতে গাজার মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, আহতদের স্থানীয় আহলি আরাব হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। কিন্তু যেহেতু গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে, তাই অনেককেই খোলা আকাশের নিচেই প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
এ দিকে কাতারের রাজধানী দোহায় গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনার কোনো অগ্রগতি হয়নি। হামাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের নতুন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরাইল। যুদ্ধবিরতির সময়কাল এবং ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি বন্দী মুক্তি নিয়ে একমত হতে পারেনি ইসরাইল ও হামাস। গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চায় হামাস। সেই সাথে ফিলিস্তিন থেকে ইসরাইলি সেনাদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেয়ারও দাবি জানিয়েছে তারা। বিনিময়ে পর্যায়ক্রমে ১০০ ইসরাইলি বন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে।
আর ইসরাইলি প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন ২০০০ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিকে ঘরে ফিরতে দেবে তারা। এতে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের রাফাহ শহর ছাড়তে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছে হামাস। যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে প্রহসন বলে উল্লেখ করেছে তারা।
ইসরাইলে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ : ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। টানা সাড়ে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে চালানো এই হামলায় এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। ইসরাইলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
তবে এরপরও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হাতে আটক থাকা বেশির ভাগ বন্দীকেই উদ্ধার করতে পারেনি ইসরাইল। এই পরিস্থিতিতে হামাসের সাথে বন্দী বিনিময় চুক্তির দাবিতে তেল আবিবে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে। এর পাশাপাশি তারা ইসরাইলে এখনই নির্বাচন আয়োজনের দাবিও তুলেছেন।
নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে তেলআবিবের প্রাণকেন্দ্র কাপলান স্কোয়ারে হাজার হাজার ইসরাইলি বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় তারা হামাসের সাথে বন্দিবিনিময় চুক্তির দাবি জানান বলে শনিবার ইসরাইলি সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
বিক্ষোভকারীরা গাজায় আটক থাকা কয়েক ডজন ইসরাইলি বন্দীর ছবি নিয়ে সমাবেশে অংশ নেয় এবং ‘এখনই নির্বাচন’ বলে স্লোগান দেয়। একই সময়ে প্রায় ৩০০ জন বিক্ষোভকারী তেলআবিবের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দফতর সংলগ্ন বিগিন স্ট্রিট বন্ধ করে দেয় বলে ইয়েদিওথ আহরনোথ সংবাদপত্র জানিয়েছে। এ সময় তারা ‘১৬৯’ লেখা একটি ব্যানার সামনে তুলে ধরে, যা চলমান যুদ্ধের দিনগুলোর সংখ্যা নির্দেশ করে। ধারণা করা হচ্ছে, নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের গতি পরবর্তীতে আরো বৃদ্ধি পাবে এবং অন্যান্য এলাকা ও শহরেও ছড়িয়ে পড়বে। ফিলিস্তিনি সরকারি সূত্র অনুসারে, ইসরাইল তার কারাগারে কমপক্ষে ৯ হাজার ১০০ জন ফিলিস্তিনিকে বন্দী করে রেখেছে। অন্য দিকে গাজায় আটক থাকা ইসরাইলি বন্দীর সংখ্যা অস্পষ্ট রয়ে গেছে, কারণ হামাস তাদের সংখ্যা প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছে।
ইসরাইলি মিডিয়া ২৪০ থেকে ২৫৩ ইসরাইলি বন্দীর গাজায় আটক থাকার কথা বলে থাকে। যার মধ্যে তিনজনকে ইসরাইল মুক্ত করেছিল এবং ১০৫ জনকে হামাস গত বছরের নভেম্বরে বন্দিবিনিময় চুক্তির সময় মুক্তি দিয়েছিল। এ ছাড়া ইসরাইলি হামলার কারণে আরো ৭০ জন বন্দীর নিহত হওয়ার কথা বলে থাকে হামাস।গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থীশিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ইসরাইলি আক্রমণ গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। জাতিসঙ্ঘের মতে, ইসরাইলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সঙ্কটের মধ্যে গাজার সকলেই এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছেন।
এ ছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ কোনো ধরনের আশ্রয় ছাড়াই বসবাস করছে এবং প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম ত্রাণবাহী ট্রাক এই অঞ্চলে প্রবেশ করছে।
ইসরাইল গাজার ওপর ব্যাপকভাবে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। এর ফলে এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দারা অনাহারের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজায় ইসরাইলের আক্রমণের ফলে এখন পর্যন্ত ৩২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজারের বেশি মানুষ।
এ ছাড়া ইসরাইল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। গত জানুয়ারিতে এই আদালতের দেওয়া এক অন্তর্বর্তীকালীন রায়ে তেলআবিবকে গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে এবং গাজার বেসামরিক নাগরিকদের মানবিক সহায়তা প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
২৪ ঘণ্টায় ৮৪ ফিলিস্তিনি নিহত : গাজায় প্রতিদিনই ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ ফিলিস্তিনিরা। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৮৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছে আরো ১০৬ ফিলিস্তিনি। গাজা উপত্যকায় এখন পর্যন্ত ৩২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইলি বাহিনী। গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সেখানে এখন পর্যন্ত ৩২ হাজার ২২৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছে আরো ৭৪ হাজার ৫১৮ জন।
খাবার ও চিকিৎসার অভাবে গাজায় ইসরাইলি বন্দীর মৃত্যু : হামাস
আনাদোলু জানায়, খাবার ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে গাজায় এক ইসরাইলি জিম্মির মৃত্যু হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে হামাস। শনিবার টেলিগ্রামে ওই বন্দীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে হামাসের সামরিক শাখা আল কাসসাম ব্রিগেড। টেলিগ্রাম বার্তায় গোষ্ঠীটি বলে, আমরা ওষুধ ও খাদ্যের অভাবে ইহুদিবাদী বন্দী ইয়েজিভ বুখাত্তাফের (৩৪) মৃত্যুর ঘোষণা দিচ্ছি। আমরা আগেই সতর্ক করেছিলাম যে শত্রুপক্ষের বন্দীরা আমাদের মানুষদের মতো একই পরিস্থিতিতে ভুগছে; ক্ষুধা, বঞ্চনা, খাদ্য ও ওষুধের অভাব। এখন এই অসুস্থতা তাদের অনেকের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে।’ তুরস্কের সংবাদমাধ্যম আনাদোলুর খবর অনুসারে, আল-কাসসামের প্রকাশিত ছোট এক ভিডিওতে ইসরাইলি বন্দীকে নিজের নাম বলতে শোনা যায়।
ভিডিওর বিষয়ে আল কাসসাম বলে, গাজার জনগণ অবরোধ এবং খাদ্য ও ওষুধের ঘাটতিতে যা ভোগ করছে, আপনার বন্দীরাও তা ভোগ করবে (ইসরাইল ও বন্দীদের পরিবারকে উদ্দেশ্য করে)। তিনি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বেঁচে গেলেও খাবার ও ওষুধের সঙ্কট থেকে রক্ষা পাননি। আল-কাসসামের এই বিবৃতির কোনো জবাব দেয়নি ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।


আরো সংবাদ



premium cement