ইসি গঠন নিয়ে ৪ প্রস্তাব আ’লীগের

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নিয়ে চার দফা প্রস্তাব দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচন কমিশনের আর্থিক অবস্থা শক্তিশালী করা, কমিশন গঠনে আইন করা এবং সব ধরনের নির্বাচনে অধিকতর তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা। জাগো নিউজ/বাসস।
দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপে এসব প্রস্তাব দেয়। পরে দলটির কার্যালয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
আওয়ামী লীগের দেয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছেÑ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮-এর বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করবেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে রাষ্ট্রপতি যেরূপ উপযুক্ত বিবেচনা করবেন, সেই প্রক্রিয়ায় তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করবেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮-এর বিধান সাপেক্ষে একটি উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। বর্তমানে এই ধরনের কোনো আইন না থাকায় সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সংবিধান ব্যতিরেকে অন্য কোনো আইন প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সাংবিধানিক চেতনা সমুন্নত রাখতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারগণের যোগ্যতা-অযোগ্যতা এবং তাদের নিয়োগপ্রক্রিয়া নির্ধারণের লক্ষ্যেই মূলত এই আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে সব নির্বাচনে অধিকতর তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এর আগে বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিটে প্রতিনিধিদল নিয়ে বঙ্গভবনে পৌঁছান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫টা ১০ মিনিটে বৈঠক শেষে বের হন তারা।
আওয়ামী লীগের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন- দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব:) মুহাম্মদ ফারুক খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান।
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো: জয়নাল আবেদীন জানান একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংলাপে বসতে রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগসহ ৩২টি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানান।
২০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি হামিদ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির সাথে সংলাপের মধ্য দিয়ে এই সংলাপ শুরু হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তবাদী দল (বিএনপি)সহ সাতটি রাজনৈতিক দল এই সংলাপে অংশ নেয়নি।
এর আগে, নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজনের বেশি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
বিগত কয়েক মেয়াদে রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। আসন্ন ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন- যার অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আইনের খসড়া অনুমোদন : সার্চেই ইসি নিয়োগ
এদিকে সংবিধান অনুযায়ী একটি আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২ এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদের মন্ত্রিপরিষদ কক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়।
বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত একটি আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন মন্ত্রিসভার বৈঠকে দেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। খন্দকার আনোয়ার আরো বলেন, সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে উপযুক্ত প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করবে।
এর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের পর রাষ্ট্রপতির গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ ও কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে সর্বশেষ দু’টি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত নাম থেকে রাষ্ট্রপতি ২০১২ ও ২০১৭ সালে সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনারকে বেছে নেন।
এ ছাড়াও মন্ত্রিসভায় এবং আরো তিনটি আইনের খসড়া অনুমোদিত হয়। এ গুলো হচ্ছে- ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০২২’ এর খসড়া, ‘বাংলাদেশ তেল গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন আইন-২০২২ এবং ‘বৈষম্য বিরোধী আইন-২০২২’। এ ছাড়াও ‘জাতীয় লবণ নীতি-২০২২’ এর খসড়াও অনুমোদন দেয়া হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘সংবিধানের ১১৮(১)-এ বিধান আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে পারেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই আইনটি নিয়ে আসা হয়েছে। খুব বেশি বড় আইন না এটি। এ জাতীয় আইন আমরা হ্যান্ডেল করে আসছি। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন আইন আছে। মোটামুটি সেই অনুযায়ী এটা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে একটা সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি গঠন করা হবে।
ছয় সদস্যের এই সার্চ কমিটির প্রধান হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। এ ছাড়া সদস্য হিসেবে থাকবেন হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহা হিসাবনিরীক্ষক, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তি।
কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিটি যোগ্য ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করবে। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। এসব পদে নিয়োগের কিছু শর্ত দেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। ওই ব্যক্তিদের কমপক্ষে ৫০ বছর বয়স হতে হবে। এ ছাড়া সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে ওই ব্যক্তিদের কমপক্ষে ২০ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
তিনি বলেন, ‘খসড়া আইনে অযোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে,-‘আদালতের মাধ্যমে কেউ অপ্রকৃতিস্থ হিসেবে ঘোষিত হলে, দেউলিয়া ঘোষণার পর দেউলিয়া অবস্থা থেকে মুক্ত না হলে, অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলে, নৈতিক স্খলন এবং সেক্ষেত্রে যদি ফৌজদারি অপরাধে কমপক্ষে দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দণ্ডিত হলে, রাষ্ট্রীয় পদে থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হতে পারবেন না।’
আগামী নির্বাচন কমিশন কী এ আইনের অধীনে হবে- জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যদি এর মধ্যে হয়ে যায়, তাহলে হবে। গতকাল অনুমোদন দেয়া হলো, হয়তো দুদিন লাগবে আইন মন্ত্রণালয়ের। তারপর যদি ওনারা সংসদে পাঠান, সংসদেও তো কয়েক দিন লাগবে। স্ট্যান্ডিং কমিটিতে যাবে, ওনারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। যদি হয় তো হয়ে যাবে, অসুবিধা তো নেই।
আইন ভাঙলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ বা পদত্যাগ কিভাবে হবে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে খন্দকার আনোয়ারুল বলেন, আমার তো যতদূর মনে পড়ে, যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা অপসারণ হন, একই পদ্ধতি প্রযোজ্য হবে। বাকিগুলো হয়তো বিধিতে উল্লেখ করে দেয়া হবে।
খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আশা করছি, আইনটি চূড়ান্ত করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। ছোট আইন।’ এ ছাড়াও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকারে বৈষম্যবিরোধী আইন, ২০২২-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, অনেকগুলো আন্তর্জাতিক কনভেনশনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে সব রকমের বৈষম্য নিরসন করা হয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। এরই আলোকে এ আইন নিয়ে আসা হয়েছে।
খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আইনের আলোকে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন- জাতীয়, বিভাগীয় ও জেলা বা যে পর্যায় পর্যন্ত হিউম্যান রাইটসের কোনো ভায়োলেশন হচ্ছে তা মনিটর করবে। তিনি জানান, এখানে একজন সভাপতি থাকবেন। আইনমন্ত্রী কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন এবং লেজিসলেটিং বিভাগের একজন যুগ্মসচিব সেটার সদস্য সচিব হবেন।
বৈষম্যবিরোধী একটা সেল গঠন করা হবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যে সেল বৈষম্যবিরোধী কার্যাবলী প্রতিরোধ এবং তাৎক্ষণিক প্রতিকার প্রদানের জন্য বৈষম্যবিরোধী জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা কমিটিসহ অন্যান্য কমিটি গঠন করবে।
‘জাতীয় লবণ নীতিমালা-২০২২’ এর খসড়ার অনুমোদন প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এখন লবণ চাষ দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে উপকূলীয় জেলাগুলোর অনেকগুলোয় ট্রাডিশনাল সিস্টেমে হচ্ছে, সেটার একটা মডিফিকেশন দরকার। মাতারবাড়ি, কক্সবাজার, পায়রায় বেশ কিছু জায়গা ডেভেলপমেন্টের কাজ হাতে নিয়েছি। সেজন্য নতুন নতুন জায়গা গ্রহণ করা এবং নতুন টেকনোলজির মাধ্যমে আরো প্রোডাক্টটিভিটি ইফেক্টিভ করা এবং বড় করার জন্য নীতিমালা নেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আশা করা হচ্ছে, ২০২০-২৫ মেয়াদি এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে আমরা লবণ উৎপাদনে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করব এবং আমাদের লবণের ঘাটতি হবে না।’