৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দুর্যোগই যেখানে আশীর্বাদ!

-

মাঝারি আকৃতির সবরি কলার হালি ১০০ টাকা, এক প্লেট ভাত ৪০ টাকা, ছোট্ট এক টুকরা ইলিশ ১২০-১৫০ টাকা, তেলেভাজা একটি ডিমের দাম ৩০ টাকা, প্রতি পিস পরাটা ১০-১৫ টাকা। এক খিলি পানের দাম ৮-১০ টাকা। পাবলিক টয়লেটে প্রস্রাব করতে ১০ টাকা! যেখানে দুর্যোগই হলো কারো কারো জন্য আশীর্বাদ। এই হচ্ছে বাংলাবাজার ফেরিঘাটের অবস্থা। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে ফেরিসহ ওই রুটের সকল নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় ঘাটে আটকে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। আর এই মানুষগুলোর অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে সেখানকার একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ব্যবসার নামে প্রকাশ্যে হাতিয়ে নেন টাকা।
হঠাৎ করেই বুধবার সকাল ৬টা থেকে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটের ফেরিসহ সকল প্রকার নৌযান চলাচল বন্ধ করে কর্তৃপক্ষ। বরিশাল এক্সপ্রেস গাড়ির সুপারভাইজার জুয়েল নয়া দিগন্তকে বলেন, তার গাড়িটি নিয়ে মঙ্গলবার রাতে ঢাকা থেকে তারা ঝালকাঠীর রাজাপুর হয়ে কাঁঠালিয়ার আমুয়ায় যায়। রাতে যখন তারা পদ্মা পাড়ি দেন তখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক। পরদিন সকালে ওই গাড়িটিতে যাত্রী নিয়ে তারা আবারো ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। শুধু ওই গাড়িটিই নয় অসংখ্য গাড়ি দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুট থেকে বাংলাবাজার ঘাটে এসে পৌছায় দুপুরের মধ্যে। জুয়েলের বরিশাল এক্সপ্রেস গাড়িটি যখন ফেরিঘাটে পৌঁছে তখন বেলা পৌনে ১টা। এসে দেখেন ফেরি চলাচল বন্ধ। নদীতে অন্য কোনো নৌযানও নেই। থেমে থেমে মাইকে ঘোষণা আসছিল-দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ থাকবে। পরবর্তী সময়টা কখন নাগাদ হতে পারে সে সম্পর্কে যাত্রীদের কাছে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না।
বুধবার সারা দিন পদ্মাপাড়ের বাংলাবাজারের আকাশ বেশ পরিষ্কার, দুর্যোগ বা ঝড়-বৃষ্টির কোনো লক্ষণ নেই। যাত্রীরা অপেক্ষা করছিলেন ফেরি ছাড়ার ঘোষণা আসবে। এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আকাশে বড় আকৃতির চাঁদ। এর আগে বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হলেও পরে আবারো আকাশ পরিষ্কার। সন্ধ্যার পরেও মানুষ অপেক্ষা করছিলেন, এই বুঝি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। তাদের কেউ কেউ আবার আবহাওয়া সংবাদ শুনছিলেন মন দিয়ে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। রাত আস্তে আস্তে গভীর হয়। তারপরেও আশায় ছিলেন যাত্রীরা। যেকোনো সময় ফেরি ছাড়তে পারে।
মাদারীপুরের গোসাইরহাট থেকে আসা এক যাত্রী আব্দুল হান্নান বলেন, তিনি যখন সকাল ৮টায় এসেছেন তখনো ফেরির লোকজন তাদের কাছে টিকিট বিক্রি করেছে। প্রতিটি টিকিটের দাম নেয়া হয়েছে ২৫ টাকা। ফেরি চলাচল যখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তখন কর্তৃপক্ষ এই টিকিট দিলো কেন? ফেরিঘাটের পাশেই দুপুরের দিকে মসজিদের ভেতরে বসে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় আবু বকরের তখন ওই মসজিদের ভেতরে শতাধিক মানুষ শুয়ে-বসে ছিলেন ফেরি পারাপারের অপেক্ষায়। আবু বকর জানালেন, ফেরি বন্ধ করে দিয়ে কেন তারা টিকিট কাটল? আবু বকরের ধারণা কর্তৃপক্ষ অন্তত ১০ হাজার মানুষের কাছে এভাবে টিকিট বিক্রি করেছে। তাদের অনেকেই ঘাটে নোঙর করা ফেরিগুলোতে অবস্থান নিয়ে বসেছিলেন। গত বুধবার সন্ধ্যার দিকে পুলিশ দিয়ে এই মানুষগুলোকে ফেরি থেকে নামিয়ে দিয়ে ফেরিঘাট থেকে কিছু দূরে নিয়ে নোঙর করে রাখা হয়।
পরিবহন সুপারভাইজার জুয়েল জানান, রাতেও যদি তাদেরকে জানানো হতো ফেরি চলবে না, অথবা সকালেও যদি তারা জানতে পারতেন তবে বাসে যাত্রী উঠাতেন না। অথচ কোনো প্রকার পূর্ব ঘোষণা দেয়নি ফেরি কর্তৃপক্ষ। জুয়েলের গাড়িতে ২৩ সিটে যাত্রী ছিলেন। তাদের কারো কারো দুধের শিশুও ছিল। বৃদ্ধ মানুষও ছিলেন এই গাড়িতে। অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় এই যাত্রীদের। বুধবার দিন-রাত তাদের এই গাড়ির মধ্যেই কেটে যায়। শিশুদের চিৎকারে অসহ্য হয়ে পড়েন তাদের অভিভাবকরাও। কিন্তু সবাই যেন অসহায়। কারো কিছুই করার নেই।
বৃহস্পতিবার সকালেও যাত্রীরা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, ফেরি ছাড়বে কি ছাড়বে না। ফলে অনেকেই বিকল্প উপায়ে ঢাকায় আসার সুযোগ খুঁজছিলেন। বিকল্প উপায় বলতে একটাই দৌলতদিয়া হয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে পাটুরিয়া এসে ঢাকায় আসা। আবার কেউ কেউ কয়েকগুণ ভাড়া গুনে ফিরে যান বাড়িতে। যাদের জরুরি কাজ ছিল তারা কয়েকগুণ ভাড়া দিয়ে পাটুরিয়া হয়ে ঢাকায় আসেন।
এ দিকে বাংলাবাজার ঘাটে অসহায় এই যাত্রীদেরকে জিম্মি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। তারা এই অসহায় মানুষগুলোর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় বাড়তি টাকা। নড়িয়া থেকে আসা ফজলে আলী নামে এক যাত্রী বলেন, তার সাথে চার সন্তান আর স্ত্রী। বৃহস্পতিবার সকালে যখন তার সাথে কথা হয় তখন তিনি প্রায় কেঁদেই ফেলছিলেন। তিনি জানান, দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে ঘাটে আসেন। পকেটে যে টাকা ছিল তা ঢাকায় আসার জন্য পর্যাপ্ত ছিল। কিন্তু বাড়তি সময় যে ঘাটে থাকতে হবে; তা কে জানত? টাকা আগের দিন দুপুরে খাওয়া খেয়েই শেষ হয়ে গেছে। এরপর রাত আর সকালে সন্তানদের শুধু মুড়ি আর পানি খাইয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। পকেটে আর টাকা নেই যে বাড়িতে ফিরে যাবেন। বিকল্প উপায়ে দৌলতদিয়া হয়ে ঢাকা যাবেন তারও কোনো উপায় নেই।
ওই সময়ে ঘাটের বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা গেছে এমন কোনো পণ্য নেই; যার দাম তারা বাড়ায়নি। বোতলের পানি থেকে শুরু করে পানের খিলি-সব কিছুরই দিগুণ-তিন গুণ দাম। পাবলিক টয়লেটে স্বাভাবিক সময়ে প্রস্রাব করতে লাগে ৫ টাকা। আর দুর্যোগের সময় ১০ টাকা। সেকেন্দার নামের এক যাত্রী বলেন, শুধু প্রস্রাব করেই দিনরাত তাকে গুনতে হয়েছে ১২০ টাকা। যাদের টাকা নেই তারা কি করবে?


আরো সংবাদ



premium cement