২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অস্কার অনুষ্ঠানে যুদ্ধবিরোধী শান্তির জয়গান

অস্কার অনুষ্ঠানে যুদ্ধবিরোধী শান্তির জয়গান -

আমেরিকান নেতৃত্বের পতন হচ্ছে। জানুয়ারি মাস থেকে ফ্রান্সে সর্বোচ্চ বিক্রীত বইয়ের তালিকায় যে নতুন বইটি উঠে রয়েছে, সেই বইয়ের যুক্তি এটি। ইংরেজি করলে বইটির নাম হবে দ্য ডিফিট অব দ্য ওয়েস্ট (পশ্চিমের পরাজয়)। বইটির লেখক ইমানুয়েল টোড একজন জনপ্রিয় ইতিহাসবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ। ১৯৭৬ সালে তিনি তাঁর দ্য ফাইনাল ফল (চূড়ান্ত পতন) বইয়ে শিশুমৃত্যুর পরিসংখ্যান ব্যবহার করে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হতে চলেছে।
ঠিক এই অবস্থায় অস্কারের মঞ্চ থেকে এবার বার্তা এলো, যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। বেশিরভাগ পুরস্কারজয়ী ছবির বিষয়বস্তুতে, বিজয়ীদের বক্তব্যে, অনুষ্ঠানের ভেন্যুর বাইরের সড়কে, লালগালিচায় সবখানেই যুদ্ধবিরোধী শান্তির জয়গান। একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস ৯৬তম অস্কারে প্রতিযোগিতামূলক ২৩টি পুরস্কার দিয়েছে। এরমধ্যে ১৩টি বিভাগে বিজয়ীদের কাজ বলছে যুদ্ধই মানবতার জন্য হুমকি। ইসরাইল-গাজা যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহ দেখা গেছে অস্কারজুড়ে। অনুষ্ঠান শুরুর আগেই সেই আভাস মিলেছে।
লালগালিচার কথা বললে, হলিউডের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন তারকা নিজেদের পোশাকে ছোট আকারের লাল বৃত্তাকার ব্যাজ নিয়ে ঘুরেছেন। এটি হলো আর্টিস্টস ফর সিজফায়ার (যুদ্ধবিরতির জন্য শিল্পীরা) গ্রুপের ব্যাজ। ফিলিস্তিনের গাজায় অবিলম্বে ও স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি, সমস্ত জিম্মিদের মুক্তিদান এবং জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সহায়তা সরবরাহে সমর্থন জানানোর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয়েছে লাল রঙের ব্যাজ।
যেসব তারকার পোশাকে লাল ব্যাজ দেখা গেছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি করে অস্কারজয়ী আমেরিকান গায়িকা বিলি আইলিশ ও তার ভাই ফিনিয়াস ও কনেল, ‘হাল্ক’ তারকা মার্ক রাফেলো, দুইবার অস্কারজয়ী আমেরিকান অভিনেতা মাহেরশালা আলি, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ অভিনেতা রিজ আহমেদ, আটটি গ্র্যামি জয়ী ব্রিটিশ ডিজে মার্ক রনসন, আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নারী নির্মাতা আভা ডুভার্নে। ‘পুয়োর থিংস’ চলচ্চিত্রের জন্য এবারের আসরে সেরা পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে মনোনীত মার্ক রাফেলো ডলবি থিয়েটারে ঢুকেই মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে ধরেন। তার মন্তব্য, আমাদের শান্তি দরকার।
মিসরীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান ও অভিনেতা রামি ইউসেফ ফিলিস্তিনিদের জন্য স্থায়ী ন্যায়বিচারের আহ্বান জানিয়েছেন। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সমর্থনে তিনিও লাল রঙের ব্যাজ পরেছেন।
আর্টিস্টস ফর সিজফায়ার গ্রুপটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে প্রায় ৪০০ শিল্পীর সই করা একটি খোলা চিঠি দিয়েছে। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য– ৯৬তম অস্কারে সেরা অভিনেতা, সেরা প্রযোজক ও সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য বিভাগে মনোনীত ব্র্যাডলি কুপার, সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে মনোনীত আমেরিকা ফেরেরা।
ইসরাইলি-আমেরিকান চলচ্চিত্র প্রযোজক ও মারভেল এন্টারটেইনমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আভি আরাদ হলুদ রঙের রিবন পরে এসেছেন। এর মাধ্যমে গাজায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হাতে বন্দী থাকা ইসরাইলি জিম্মিদের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন তিনি। ভ্যানিটি ফেয়ার ম্যাগাজিনের অস্কার-পার্টির ভেনুর কাছাকাছি একটি ভবনের দেয়ালে ইসরাইলি জিম্মিদের বিশালাকার ছবি প্রদর্শন করা হয়েছে। জিম্মিদের পরিবারের সমর্থকরা এই কর্মসূচির আয়োজন করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের লসঅ্যাঞ্জেলেসের হলিউড অ্যান্ড হাইল্যান্ড সেন্টারের ডলবি থিয়েটারে ১০ মার্চ রাতে (বাংলাদেশ সময় ১১ মার্চ ভোর ৫টা) ছিল অস্কারের জমকালো আসর। লালগালিচা অনুষ্ঠান চলাকালীন ভবনটির বাইরে ও আশেপাশে ফিলিস্তিনপন্থী হাজারও বিক্ষোভকারী সড়কে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করায় যানচলাচলে বিঘœ ঘটে। ‘কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন’ ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রী বিভাগে মনোনীত লিলি গ্ল্যাডস্টোনের মতো অনেক তারকা গাড়ি ছেড়ে পায়ে হেঁটে ডলবি থিয়েটারে ঢুকেছেন। তখন হলিউডের সড়কপথের একটি বড় অংশ থমকে ছিল। ট্রাফিক জ্যাম লেগে যাওয়ায় পাঁচ মিনিট দেরিতে শুরু হয় পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান।
গাজার সাথে যুদ্ধে ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। তারা স্লোগান দিয়েছেন, ‘এখনই যুদ্ধবিরতি’, ‘এখনই গাজা অবরুদ্ধ করে রাখা থামান।’ তাদের একজনের প্ল্যাকার্ডে দেখা যায়, ‘আপনি যখন অস্কার দেখছেন, গাজায় তখন বোমাবর্ষণ হচ্ছে।’
বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন জিনাব নাসরু নামের এক নারী উদ্যোক্তা। তার মন্তব্য, যখন মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে ও বোমা হামলা হচ্ছে, তখন অস্কারের চাকচিক্য চলছে।
আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন কিউবান নারী নির্মাতা ভিভিয়েন ওয়াইজম্যান। তিনি বলেন, আমি এখানে প্রতিবাদ জানাতে এসেছি এবং বলতে এসেছি যে, যখন গণহত্যা চলছে তখন অস্কারসহ স্বাভাবিক কোনো কিছুই হতে পারে না। যুদ্ধের ঘটনায় অস্কার কর্তৃপক্ষের নীরবতার জন্য আমরা তাদের নিন্দা জানাই।’
না, অস্কার নীরব থাকেনি। বরং অন্য যেকোনো আসরের চেয়ে এবার আয়োজক ও সদস্যদের সরব ভূমিকা দেখা গেল। যুদ্ধভিত্তিক যে ছয়টি চলচ্চিত্র ১৩টি পুরস্কার জিতেছে সেগুলোর নির্মাতারা শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন মঞ্চে দাঁড়িয়ে। সেগুলো নিয়ে কথা বলা যাক এবার।
দ্য জোন অব ইন্টারেস্ট (২টি অস্কার) : সেরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারজয়ী ‘দ্য জোন অব ইন্টারেস্ট’-এর পরিচালক জনাথান গ্লেজার পুরস্কার গ্রহণ করে নিজের বক্তৃতায় গাজায় যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করেন। তার মন্তব্য, ‘ইসরায়েল ও গাজায় নিহতরা অমানবিকতার শিকার। ইসরাইলে ৭ অক্টোবরের ক্ষতিগ্রস্তরা হোক কিংবা গাজায় চলমান হামলা, সবাই অমানবিকতার শিকার। এসব আমরা কিভাবে প্রতিরোধ করব?’
টোয়েন্টি ডেজ ইন মারিউপোল (১টি অস্কার): সেরা প্রামাণ্যচিত্র বিভাগে অস্কার জিতেছে পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী ইউক্রেনিয়ান সাংবাদিক মিস্তিস্লাভ চেরনোভ পরিচালিত ‘টোয়েন্টি ডেজ ইন মারিউপোল’। এটাই ইউক্রেনের প্রথম অস্কার। মিস্তিস্লাভ চেরনোভের পাশাপাশি অস্কারের সোনালি ট্রফি পেয়েছেন প্রামাণ্যচিত্রটির দুই প্রযোজক র্যানি অ্যারনসন-রাথ ও মিশেল মাইজনার। রুশ আক্রমণের পর অবরুদ্ধ হয়ে পড়া ইউক্রেনের মারিউপোল শহরে ২০২২ সালের মার্চে ২০ দিন কাটিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটির শুটিং করেন মিস্তিস্লাভ চেরনোভ। পুরস্কার গ্রহণের পর তিনি জানিয়েছেন, শান্তির বিনিময়ে তার এই অস্কার দিয়ে দেবেন রাশিয়াকে।
ওয়ার ইজ ওভার! (১টি অস্কার): সেরা অ্যানিমেটেড স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার জিতেছে ডেভ মালিন্স পরিচালিত ‘ওয়ার ইজ ওভার! ইন্সপায়ার্ড বাই দ্য মিউজিক অব জন অ্যান্ড ইয়োকো’। তিনিই এর গল্প লিখেছেন। তার ও প্রযোজক ব্র্যাড বুকারের পাশাপাশি মঞ্চে ছিলেন ছবিটির নির্বাহী প্রযোজক কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী জন লেনন ও ইয়োকো ওনো দম্পতির ছেলে শন ওনো লেনন। তিনি ইয়োকো ওনোকে মা দিবসের শুভেচ্ছা জানাতে দর্শকদের প্রতি অনুরোধ করেন। তার কথায়, আমার মা গত মাসে ৯১ বছরে পদার্পণ করেছে। আজ যুক্তরাজ্যে মা দিবস। তাই সবাই কি বলতে পারি, মা দিবসের শুভেচ্ছা ইয়োকো? অতিথিরা সবাই তখন সমস্বরে ইয়োকো ওনোকে মা দিবসের শুভেচ্ছা জানান।


আরো সংবাদ



premium cement