‘আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ, সবুজ শ্যামল অপরূপ এক দৃশ্য। দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত আর পরিপাটি বাড়িঘর। সব কিছুই সুন্দর সাজানো গোছানো। যেন এক রূপকথার গ্রাম, যেখানে শিক্ষার হার শতভাগ; নিরক্ষর নেই একজনও। প্রতিটি বাড়ির ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষিত। নেই চুরি, ডাকাতি বা মাদকের আখড়া। ঝগড়াবিবাদ নেই বললেই চলে। দুঃখে মানুষের পাশে দাঁড়ানো আর সুখে আনন্দ ভাগাভাগি করাই এ গ্রামের মানুষের বৈশিষ্ট্য।
নয়া দিগন্তের একটি সচিত্র প্রতিবেদনের এটা সূচনা অনুচ্ছেদ। বাংলাদেশে যেখানে সর্বপ্রকার অপরাধ-অশান্তি বেড়ে চলেছে, সে ক্ষেত্রে নাটোরের চলনবিলস্থ সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নের হুলহুলিয়া গ্রামটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তার কথাই এখানে বর্ণিত হয়েছে।
অবাক করা ব্যাপার হলো নাটোর জেলা সদরের ৩৭ কিলোমিটার এবং সিংড়া থানা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ গ্রামের অবস্থান। ১৩টা পাড়ার এ গাঁও আয়তনে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এবং চলনবিল দ্বারা পরিবেষ্টিত। এ গ্রামে শিক্ষা ও স্যানিটেশনের হার প্রায় এক শ’ ভাগ। এখানে রয়েছে মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা, পোস্ট অফিস, উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, প্রাইমারি স্কুল ও হাইস্কুল। হুলহুলিয়া গ্রামে এক শ’ বছরেও পুলিশকে আসতে হয়নি। কারণ এ সময়ে কোনো মামলা করেননি কেউ।
১৯১৪-১৫ সালে প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে এ গাঁয়ে অভাব দেখা দিয়েছিল। সেই বানের পর অনেকে বীজের অভাবে ধানী জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় মাতবর পরিবারপ্রতি একজন করে ডেকে নিয়ে সভা করে সিদ্ধান্ত নেন, অতিরিক্ত ধানবীজ থাকলে নিঃশর্তভাবে অন্যকে তা ধার দিতে হবে। সে অনুসারে, সব জমি ফসলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি সংগঠন গঠিত হয়, যা আজ ‘সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামে সুপ্রতিষ্ঠিত। তার দ্বারা গ্রামের সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে। প্রত্যক্ষ ভোটে দুুই বছর পরপর ২৩ সদস্যের পরিষদ নির্বাচিত হয়ে থাকে। গ্রামের বাসিন্দাকে অন্তত এসএসসি পাস হতেই হবে। প্রয়োজনে পরিষদ তার লেখাপড়ার ব্যয় বহন করে। গ্রামের সব বিরোধ ৬৪ বছর পুরনো বিচারক প্যানেল মীমাংসা করে থাকে। ১৫২ বছর আগেই প্রাথমিক বিদ্যালয় এখানে চালু হয়। ১৯৪৪ সালে ক্লাব গড়ে ওঠে। এ গাঁয়ে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আছে একাধিক, যারা সামাজিক ও অরাজনৈতিক। এসব সংগঠনের চাকরিজীবী সদস্যদের সাহায্যে অভাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, অসহায় ব্যক্তিদের সহায়তা এবং বেকারদের কর্মসংস্থান করা হয়ে থাকে। এ গ্রামের জন্য দেশের সর্বপ্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার ও পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক ডিরেক্টর মরহুম হানিফ উদ্দিন মিয়া, রাজউক-এর সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এম এম রহমত উল্লাহ, আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব মরহুম এ কে তালুকদারসহ কয়েকজনের বিশেষ অবদান অবিস্মরণীয়। ৫৭ বছর আগে হানিফ উদ্দিনের মাধ্যমেই বাংলাদেশে কম্পিউটারের আগমন। ২০১৬ সালে জেডটিইর সহযোগিতায় প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে ‘ডিজিটাল হাব’ স্থাপন করা হয়েছে। এতে আছে ১১টা কম্পিউটার, দু’টি ওয়াই-ফাই জোন, একটি প্রজেক্টর এবং বিটিসিএল লাইন।
স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেছেন, “এ গাঁয়ের সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে সজাগ। এখানকার কেউ কোনো দিন থানায় যাননি মামলা করতে। সব কিছু সুরাহা হয় ‘সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ দ্বারাই। কেউ স্থানীয় বিচারে আগ্রহী না হলে এক মাস পরে যেতে পারেন আদালতে। সন্তানদের শিক্ষিত করছি পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য। এতে সমাজের বন্ধন অটুট থাকবে।” পূর্বোক্ত পরিষদের প্রধান বলেন, নিজস্ব বিধিবিধান দিয়ে এ গাঁয়ে ঝগড়াবিবাদের মীমাংসা করা হয়। থানায় বা কোর্টে আর যেতে হয় না। বাল্যবিয়ে নেই এ গ্রামে; কারণ এখানে সবাই শিক্ষিত। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বলেছেন, শতভাগ শিক্ষিতের এ গ্রামে কারো বিচার করতে হয় না। ইউএনও বলেছেন, ‘হুলহুলিয়া গ্রামে শত বছরেও মামলা হয়নি বলে শুনেছি। বাস্তবে বিস্ময়কর এ গাঁয়ে নিজেদের নিয়মেই সব কিছু চলে। গোটা দেশের সঙ্ঘাত ও বিরোধের মধ্যে হুলহুলিয়া যেন শান্তির জনপদ।’ এই দেশে যে আজো এমন গ্রাম থাকতে পারে, এটা আপাতত যতই আজব বলে মনে হোক না কেন, সেটিই বাস্তবতা। আমাদের দেশের সব গ্রাম এমন শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠুকÑ এটাই সবার প্রত্যাশা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা