২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
কোটি শিশুর পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে

জাতির ভবিষ্যৎ আজ বিপন্ন

-

চলমান বৈশ্বিক মহামারীর প্রেক্ষাপটে গত ১৮ মার্চ থেকে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। জানা গেছে, দেশের স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি অন্তত আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাস বন্ধ থাকতে পারে। ইতোমধ্যেই কোটি শিশুর লেখাপড়া কার্যত শিকেয় উঠেছে। ওরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং তাদের বেশির ভাগই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। তাই তাদের বাড়িতে পড়ার সুযোগ সামান্য। ইতোমধ্যে চালু হওয়া টিভির ক্লাসও কার্যকর হয়নি। অনেকের টিভি নেই এবং বহু স্থানে নেই বিদ্যুৎ। রাজধানীতে বসে যতই ‘অনলাইন শিক্ষা’র কথা বলা হোক না কেন, গ্রামাঞ্চলের মানুষের বেশির ভাগের জন্য তা আজো ‘হনুজ দূর অস্ত’ বা অনেক দূরে। এ অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থার প্রাইমারি পর্যায়েই বিপুল শিক্ষার্থী ড্রপ-আউটে পরিণত হবে এবং এতে জাতির শিক্ষাসঙ্কট তীব্রতর হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পত্রপত্রিকার খবরে আরো বলা হয়েছে, করোনা জীবাণুর সংক্রমণ অব্যাহত থাকায় এবং অনেক ক্ষেত্রে বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত খুলছে না। স্বয়ং সরকারপ্রধান বলে রেখেছেন, মহামারী চলতে থাকলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকতে পারে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের ভাষায়, ‘যে অবস্থা, তাতে সেপ্টেম্বরের আগে খোলা যাবে না। আগে শিশুদের নিরাপত্তা, পরে অন্যকিছু।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘করোনা সংক্রমণের যে পরিস্থিতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলেও এখন কেউ সন্তানদের পাঠাবেন বলে মনে হয় না।’
প্রতিষ্ঠান চার মাসের বেশি আগে থেকেই বন্ধ। ফলে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী নিদারুণ ঝুঁকিতে রয়েছে। আটকে আছে এইচএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। বাড়ছে সেশনজট। স্কুল-কলেজ-মাদরাসা পড়ছে অর্থসঙ্কটে। যত বেশি বন্ধ থাকবে, এসব ক্ষতি ততই বেড়ে যাবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্কুলপর্যায়ে টিভিতে ক্লাস প্রচার এবং ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে অনলাইন ক্লাসের ওপর গুরুত্ব দেয়া হলেও এসব উদ্যোগ তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। এ দিকে, কম সিলেবাসে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া এবং শিক্ষাবর্ষ মার্চ পর্যন্ত প্রলম্বিত করার চিন্তাভাবনা বাস্তবায়ন করা নির্ভর করছে বিরাজমান পরিস্থিতির ওপর।
দেশের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই সরকারি। সেগুলোতে তালা ঝুলছে। শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পড়ানোর কেউ নেই। ‘অনলাইন’ নাগালের বাইরে। করোনাকালে অভাব বেড়েছে, ঠাঁই নড়েছে। অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর পরিবার শহর ছেড়ে চলে গেছে। দেশের সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোর বিপুল শিক্ষার্থী আর লেখাপড়ায় ফেরার সম্ভাবনা নেই। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের অর্জন নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। সরকার শিক্ষকদের বলেছে মোবাইলে লেখাপড়ার তদারক করতে। কিন্তু অনেক গরিব পরিবারের সে সুযোগ নেই। গৎবাঁধা বলে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টিভির ক্লাসের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। শুধু বড় কয়েকটি স্কুলে অনলাইন ক্লাস চলছে। এমনকি, রাজধানীর কোনো কোনো সরকারি স্কুলে শিক্ষকদের দেখা মেলে না। একজন প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘প্রায় সব অভিভাবকের মুঠোফোন থাকলেও অনলাইন ক্লাসের জন্য চাই স্মার্টফোন।’ আগামী নভেম্বরে পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অপর দিকে, করোনা মহামারীর জের ধরে ‘ঝরে পড়া’দের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে বলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় জানায়, ২০০৫ সালে ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণী শেষ না করেই ঝরে পড়ত। এই হার পরে ১৮ শতাংশে নেমে এলেও এখন তা বাড়তে পারে। শিক্ষা নিয়ে তৎপরÑ এমন ১১৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ১১টি শিক্ষক সংগঠনের অংশ নেয়া জরিপে জানা গেছে, বাড়তে পারে ঝরে পড়া, স্কুলে অনিয়মিত উপস্থিতি, শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ বলেছে, ‘করোনার পর বিশ্বে প্রায় এক কোটি শিশু আর স্কুলে ফিরবে না। দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হ্রাসের ফলেই এ অবস্থা হবে।’
সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন শিক্ষা কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বাইরে পড়ায় আগ্রহী নয়। বাংলাদেশে তাদের ৭০ ভাগই সরকারি স্কুলে পড়ে। এমন স্কুল আছে প্রায় ৬৬ হাজার।
‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। ওরাই দেশের ভবিষ্যৎ; জাতির আগামী দিনের কাণ্ডারি। তাই তাদের গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে জরুরি মনোযোগ দিতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement