২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে নিদারুণ ব্যর্থতা

কূটনীতিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ

-

গণহত্যা চালিয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগে বাধ্য করার ফলে সরাসরি ভুক্তভোগী রাষ্ট্র হলো প্রতিবেশী বাংলাদেশ। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে তাদের সার্বিক দেখাশোনার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে আমাদের দেশটিকে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। সেই কাজটি করেছে দূরবর্তী আফ্রিকার ক্ষুদ্র দেশ গাম্বিয়া। মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের বিচারবহির্ভূত হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, জীবিকা ধ্বংস ও নিপীড়ন প্রভৃতি অপরাধের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালত অন্তর্বর্তী আদেশ দেবে ২৩ জানুয়ারি।
সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও বাংলাদেশ যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জোরালো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ কূটনৈতিক ব্যর্থতা। মিয়ানমারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে দেশটিকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে বাধ্য করতে পারে, এমন দুই প্রতিবেশী দেশ হচ্ছে ভারত ও চীন। দু’টি দেশের সাথেই বাংলাদেশের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বিশেষ করে ভারতের সাথে এ দেশের সম্পর্ককে নজিরবিহীন বললেও কম বলা হবে। অথচ রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের সমর্থনও আমরা পাইনি। এই ইস্যুতে প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের বিপক্ষে এবং মিয়ানমারের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে প্রভাবশালী এই দুই মিত্র দেশ। কেন এই বৈরী আচরণ তার কোনো কারণ ও যুক্তি পাওয়া যায় না।
রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যক্রমে মিয়ানমার যখন কোণঠাসা, তখনই দেশটির পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে চীন। রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ কয়েক শ’ কোটি ডলারের প্রকল্প-চুক্তি এবার স্বাক্ষর করেছে দেশটি। চীনের এই নতুন ও বিশাল বিনিয়োগ মিয়ানমারের জন্য এক উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করবে। বিশ্লেষকরা ধারণা ব্যক্ত করেছেন যে, চীনের এই মদদে উজ্জীবিত মিয়ানমার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহিতার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের দাবির প্রতি অবজ্ঞা দেখাতেও উৎসাহিত হতে পারে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের কণ্ঠেও শোনা গেছে একই অভিমত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সি আর আবরার নয়া দিগন্তকে বলেন, চলমান ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা ফুটে ওঠে। চীন ও ভারতকে আমরা ‘বন্ধুভাবাপন্ন দেশ’ বলে দাবি করি। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই দুই দেশের কোনোটিকেই বাংলাদেশ পাশে পেল না। এ ক্ষেত্রে সরকার জোরালো দূরের কথা, দেশ দু’টি থেকে ন্যূনতম সমর্থনও আদায় করতে পারেনি। রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশ কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে রয়েছে। এটি উদ্বেগজনক।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এই পিছিয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে পত্রিকান্তরে খবর এসেছে যে, আগামী ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের সর্বোচ্চ ফোরাম বিডিএফের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, তাতে রোহিঙ্গা ইস্যু আলোচ্যসূচিতে থাকছে না। আলোচ্যসূচিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন, প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনার বিভিন্ন ইস্যু ঠিক করা হয়েছে যথারীতি। কিন্তু স্থান পায়নি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোহিঙ্গা ইস্যু। অথচ সর্বশেষ গত অক্টোবরে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায়ও রোহিঙ্গা ইস্যুর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে ২০১৮ সালের এপ্রিলে ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বার্ষিক সভায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা ও করণীয় বিষয়ে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
এবার বিডিএফ বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু না রাখা থেকে স্পষ্ট যে, বিষয়টিকে বাংলাদেশ সরকার মোটেও অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখেনি। অথচ রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি বড় প্রতিবন্ধক, সেই সত্য অস্বীকার করা কোনো সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম একটি পত্রিকাকে বলেন, বিডিএফ বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু স্থান পাওয়া উচিত। এটা যেহেতু উন্নয়ন ও অর্থায়নসংশ্লিষ্ট বিষয়ের সর্বোচ্চ ফোরাম, আর রোহিঙ্গা ইস্যুটা বাংলাদেশের জন্য বেশ জটিল, তাই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।
কূটনৈতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া কোনোভাবেই কাম্য ও গ্রহণযোগ্য নয়।


আরো সংবাদ



premium cement