১৬ মে ২০২৪, ০২ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫
`


উপহার

-

খোলা জানালায় পাখির কিচির মিচির ডাক আর ফুরফুরে বাতাসে বিজয় বাবুর ঘুম ভাঙে। হ্যাঁ বাড়ির সবাই পুচকে ছেলেটাকে শুধু বিজয় নয় বিজয় বাবু বলেই ডাকে। পাঁচ বছরের বিজয় বেশ বুদ্ধিমান। সে উড়ন্ত পাখি খুব ভালোবাসে। দেখতে সুন্দর, চেহারায় পণ্ডিত পণ্ডিত ভাব আছে। খুব শান্ত আর হাসিখুশি।
প্রতিদিন সকালে নাতির পাশে বসে একগাল হাসি দেখার জন্য অপেক্ষা করেন সেতারা বেগম। ঘুম থেকে উঠেই আজো দাদুর গলা জড়িয়ে একটি মিষ্টি হাসি উপহার দেয় ছোট্ট বিজয়। ছোটে যায় জানালায়। একটি শালিকের সাথে তার দেখা হয়, কথা হয়। এটি তার প্রতিদিনের কাজ। এই শালিক পাখিটির সাথে তার ভাব হয়েছে। প্রতিদিন সকালে জানালায় শালিকটি আসে, বিজয়ের সাথে দেখা হয়। বিজয় ওকে খাবার দেয়। সেতারা বেগম নাতির পাখি বন্ধুর জন্য খাবার রেডি রাখেন। পাখি খাবার খেয়ে পাখা মেলে উড়ে যায় নীল আকাশের দিকে। বিজয় তাকিয়ে দেখে আর মনে মনে বলে- ইস আমার যদি পাখা থাকত আমিও ওই শালিক বন্ধুর মতো উড়তে পারতাম আর তখন দু’জনে একসাথেই। আহ! কি মজাই না হতো। পাখি তো আজো উড়ে চলে গেল। কিন্তু আজ বিজয় বাবুর মনটা ভার। সেতারা বেগম মুচকি হেসে হাত দুটো বাড়িয়ে দেন। নাতিকে কোলের কাছে নিয়ে মাথায় হাত বুলান, বলেন, কী হয়েছে দাদুভাই? মুখটা ভার কেন? বিজয় দাদুর গলা ধরে বলে- অ দাদু, বাবা আসবে কবে? আজো আসেনি।
সেতারা বেগমের বুকের ভেতর টনটন করে। আঁচল টেনে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নেন। বলেন, সে কথা পরে হবে, এখন চল হাত মুখ ধুয়ে নাশতা খাবে। মা খুব মজার নাশতা বানিয়েছে আমাদের জন্য। দেরি করলে মা আমাদের বকবে।
-না আমি বাবার সাথে খাব। বাবাকে এনে দাও। আচ্ছা দাদো বাবা কোথায় গেছে? বলো না বাবা কোথায় গেছে। কতদিন বাবা আমাকে আদর করে না। আমিও বাবাকে আদর করতে পারি না। বাবার জন্য আমার কষ্ট লাগে, কান্না পায় খুব।
নাতির কথায় সেতারা বেগমের দু’চোখ ভিজে যায়। তিনি বলেন, ওই যে দূর আকাশে যিনি আছেন, আমাদের রব, তার কাছে বলো তোমার বাবা যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে। তিনিই তো সব ব্যবস্থা করেন। বিজয় বলল, তুমি তো কিছুই জানো না। আল্লাহ কি দূরে থাকেন। তিনি তো সবার পাশে আছেন।
-ও, তাহলে আর ভয় কিসের তিনি তোমার বাবাকে ঠিক সময় মতো আমাদের কাছে পৌঁছে দেবেন। এখন চল আমরা নাশতা খাই।
সেতারা বেগম বিজয়কে খাওয়ান নিজে আর খেতে পারেন না। বারবার ছেলের মুখটি মনে পড়ে। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলেন, বাছা আমার কোথায় আছে? কেমন আছে? কী খাচ্ছে? কে জানে।
বিকেলে ঠাণ্ডা পরিবেশে বিজয় শান্ত ঠিকই তবে বাবার জন্য তার যে মোটেই ভালো লাগছে না। সে মনে মনে বলে ছোট মানুষের কষ্ট বড় মানুষরা বুঝতে পারে না। চোখ দুটো ছল ছল করে উঠে তার। সে আবার মনে মনে বলে, বাবা তুমি কোথায় চলে গেছ? আমার সোনা বাবা, আমার মিষ্টি বাবা। চলে এসো। আমি আর দুষ্টুমি করব না। চলে এসো। এসে দেখ তোমার বিজয় সোনা কত্ত ভালো হয়ে গেছে। তোমার বিজয় সোনা কাঁদছে তো বাবা।
নিজেকে আর সামলাতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। কান্না শুনে বিজয়ের মা প্রমা চলে এলো আর সেতারা বেগমও। দু’জন বিজয়কে অনেক আদর করে কান্না থামাল। সেতারা বেগম ওকে বাইরে নিয়ে গেলেন। বাইরে রাস্তার ধারে ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছে। বিজয় দাদুর হাত থেকে তার বড় গাড়িটি নিয়ে খেলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ খেলার পর বাদল এসে দাঁড়ায় তার পাশে। বাদল ক্লাস টেনে পড়ে। সে বিজয়কে বলে, কিরে পুচকে তর বাবা কোথায়?
কথাটি বিজয়ের পছন্দ হলো না, তাই কোনো কথা না বলে সে চুপ করে আছে। বিজয় অসুন্দর কথা পছন্দ করে না। বাদল আবার বলে, কিরে কথা কানে যায় না?
সেতারা বেগম ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, শিশুদের সাথে ওভাবে কথা বলতে নেই বাছা।
বাদল একটা বেয়াদব ছেলে। তাই সেতারা বেগমের কথা শুনে হা হা করে কিছুক্ষণ হেসে নেয়, তার পর হাসতে হাসতে বলে, বিজয় তর বাপ কই গেছে তা আমরা জানি।
বিজয় তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি জান আমার বাবা কোথায় গেছে?
- হ্যাঁ জানি তো। তর বাবা যুদ্ধ করতে গেছে।
- যুদ্ধ? সেটি আবার কী?
- যুদ্ধ মানে মারামারি। তর বাবা মারামারি করতে গেছে। কয়দিন পর নিজেই গুলি খাইয়া মরব।
সেতারা বেগম কোনো কথা না বলে বিজয়কে বাসায় নিয়ে গেলেন। খাটের উপর বসিয়ে খুব আদর করে বললেন, বাবা কোথায় গেছে আমি জানি, আমি তোমাকে বলব। বাদল কিছু জানে না। ও মিথ্যে বলেছে তোমাকে।
ততক্ষণে বিজয়ের দু’চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। দাদু তাহলে মিথ্যে কথা বলেছে।
বিজয় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে- বাবা কোথায় গেছে, তোমরা জেনেও আমাকে বলোনি। তোমরা বলো টিচার বলেন, মিথে কথা বলা অনেক বড় পাপ। আর আজ তোমরাই মিথে বলছ।
নাতিকে এখন কিভাবে বুঝাবেন ভেবে পাচ্ছেন না সেতারা বেগম। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে তারপর প্রমাকে ডেকে বলেন, বউমা এদিকে এসো। তার কাছে ঘটনা খুলে বলেন। তখন প্রমা হঠাৎ বলে উঠে, বিজয়ের বাবা তো অনেক বড় একটি উপহার আনতে গেছে।
বিজয় মায়ের কথা শুনে বলে, উপহার মানে গিফট তাই না মা? বাবা কার জন্য উপহার আনতে গেছে।
- আমাদের সবার জন্য।
- আচ্ছা মা, বাবা কবে আসবে?
- অনেক বড় উপহার আনতে গেছে তো তাই বেশ কিছু দিন সময় লাগবে। তুমি অপেক্ষা করো আর আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেন তিনি তোমার বাবাকে সাহায্য করেন, আর তোমার বাবা খুব তাড়াতাড়ি উপহার নিয়ে ঘরে ফিরতে পারে তোমার কাছে।
- মা, উপহারটা আসলে কী? কী জিনিস আনবে বাবা?
- স্বাধীনতা।
- স্বাধীনতা? স্বাধীনতা কী মা?
প্রমা ভাবে, পাঁচ বছরের শিশুকে সে কিভাবে বুঝাবে স্বাধীনতা কী? এ তো খুব কঠিন কাজ। সে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। সেতারা বেগম বুঝতে পেরে বলেন,
- দাদুভাই, আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি- স্বাধীনতা কাকে বলে। আচ্ছা দাদুভাই, তুমি প্রতিদিন যে শালিক পাখির সাথে কথা বলো, খাবার খেতে দাও, ওই পাখিটি খাবার খেয়ে উড়ে যায়। তোমার কাছে প্রতিদিন আসে। কারণ তুমি ওকে খাবার খেতে দাও। ভালোবাস। কিন্তু ওকে বন্দী করে রাখো না। ওকে কোনো কষ্ট দাও না। বকা দাও না। ওর কিন্তু স্বাধীনতা আছে তাই ও নিজের ইচ্ছেমতো তোমার সাথে দেখা করে খেয়ে আবার উড়ে চলে যেতে পারল। যদি কেউ ওকে খাচায় বন্দী করে রাখে তাহলে ওর আর স্বাধীনতা থাকবে না। ও তখন ইচ্ছে হলেও উড়তে পারবে না। ক্ষিধে পেলে কেউ ওকে খাবার না দিলে ও খেতেও পারবে না। বন্দী থাকলে কেউ যদি ওকে মারতে চায়, মারতে পারবে। কারণ ও বন্দী, পরাধীন। ওর স্বাধীনতা নেই। পরাধীন মানে ওকে অন্যের কথা শুনে চলতে হয়। নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারবে না।
- আচ্ছা দাদু, আমারও তো স্বাধীনতা আছে। আমি তো নিজের ইচ্ছেমতো সব করতে পারি।
- হ্যাঁ দাদুভাই, তোমার স্বাধীনতা আছে তোমার ঘরের ভেতরে। বাইরে খেলতে গিয়েছিলে, দেখলে বাদল ভাইয়া তোমাকে কত বাজে কথা বলল। তোমাকে কাঁদিয়ে দিলো। এটা তো খুব ছোট্ট সমস্যা। কিন্তু দেশে অনেক বড় বড় সমস্যা আছে। তুমি তো ছোট মানুষ তাই এত কিছু তুমি জানো না। সম্পূর্ণভাবে তুমি এখন বুঝতে পারবে না। বড় হলে সব বুঝতে পারবে। তোমার বাবা যে স্বাধীনতা আনতে গেছে। সেই স্বাধীনতা আনলে সারা দেশ শান্তি পাবে। দেশ মুক্ত হবে। তুমি বড় হয়ে স্বাধীন দেশের মানুষ হয়ে স্বাধীনভাবে সব কাজ করতে পারবে। এখন সব কিছু স্বাধীনভাবে করা যায় না দাদুভাই। যাই হোক, তুমি অপেক্ষা করো, একদিন তোমার বাবা স্বাধীন দেশের লাল-সবুজ পতাকা হাতে নিয়ে আসবে। সেদিন বেশি দূরে নেই দাদুভাই।
- অ দাদু দেশে কি সত্যিই যুদ্ধ হচ্ছে। মানে মারামারি হচ্ছে। সবাই যে বলে, দেশের অবস্থা ভালো নেই। মানুষ মারা যাচ্ছে।
- হ্যাঁ দাদুভাই, দেশের স্বাধীনতা আনতে গিয়ে এমন হচ্ছে। তবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
দাদুর কথাগুলো শুনার পর বিজয়ের চোখে একটিই ছবি ভাসে- বাবা আসছে স্বাধীন পতাকা হাতে নিয়ে আর বিজয় দৌড়ে বাবার কাছে যাচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement