২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


প্রাণের বইমেলা

-


বলা হয়ে থাকে, বই হলো অনন্ত যৌবনা। একটি ভালো মানের বই কোনো দিন বুড়ো হয় না। আবেদন হারায় না। বইয়ের পাতাগুলো পুরনো হয়ে যেতে পারে, ছিঁড়ে যেতে, জলে ভিজে যেতে পারে, আগুনে পুড়ে যেতে পারে কিংবা অন্য কোনোভাবে বিনষ্ট হতে পারে; কিন্তু এত কিছুর পরও একটি ভালো বই তার পাঠকের অন্তর থেকে কখনো হারিয়ে যায় না। মুছে যায় না। বরং ক্ষেত্রবিশেষে আবেদন দিন দিন বৃদ্ধি পায়। এমনকি একজন পাঠকের অন্তর থেকে অন্য আরেকজন পাঠকের অন্তরে ভাব ট্রান্সফার হয়। এভাবেই একটি ভালো বই তার যৌবন অনন্তকাল ধরে রাখে।
চার ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি, বাবা-মা, ভাইবোন সবার হাতে হাতে বই। বলা চলে, একটি পাঠক পরিবারে আমি বড় হয়েছি। সঙ্গত কারণেই আমিও সেই বাল্যকাল থেকেই বইয়ের সাথে আছি। দস্যু বনহুর সিরিজ থেকে শুরু। এরপর মোহন সিরিজ, বাহরাম সিরিজ, দস্যুরানী সিরিজ, রানা সিরিজ এসব পড়তে পড়তে একটা সময় নাওয়া-খাওয়ার কথাও ভুলে যেতাম। মাঝে মাঝে মা বকুনি দিতেন। বলতেন, আউট বই এত পড়লে পাঠ্যবই কখন পড়বি...? জানতাম, মায়ের কথা একান্তই সত্য; কিন্তু মন মানতো না। পরের বইয়ে কী ঘটনা ঘটল সেটা জানার জন্য ছটফট করতাম! সেই আমি এখনো একজন আপাদমস্তক পাঠক। রবীন্দ্র-নজরুল-শরৎসহ আরো অনেকের লেখা এখনো আমাকে ভিন্ন ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়।

নিজের সম্পর্কে একটা ছোট্ট ফিরিস্তি ইচ্ছে করেই দিলাম। কারণ নতুন প্রজন্ম আমাদের মতো নয়। আমাদের সময় একটা পাঠকসমাজ ছিল। আর এখন আছে মোবাইলসমাজ। ছোট-বড় সবার হাতে হাতে বইয়ের বদলে মোবাইল শোভা পায়। এখন ইন্টারনেট যেন বিনোদনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, মেসেঞ্জার ও অনলাইনে একা অথবা গ্রুপ ভিত্তিক গেমস খেলার রয়েছে অবারিত সুযোগ। এভাবেই আমাদের নতুন প্রজন্ম বদলে যাচ্ছে। আমরাও প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছি। আগে আমরা যেখানে চার-পাঁচজন মিলে চায়ের স্টলে আড্ডা দিতাম। এখন আড্ডা দিই। কিন্তু এখন সেই আড্ডাটা আর আগের মতো জমে না। কারণ মোবাইল। কেউ কারো কথা তেমন একটা শোনে না। শোনার তেমন আগ্রহ নেই। সবাই নিজ নিজ মোবাইল টিপাটিপি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তবে এত কিছুর পরও যে পাঠক একেবারেই নেই... আমি সে দাবি করছি না। কিছু পাঠক এখনো আছেন। কিন্তু আগের মতোন নেই!

কেন আগের মতোন নেই? এটি একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। যেহেতু আমি বই প্রেমিক, সেহেতু যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন... বইমেলায় আমার যাওয়া চাই-ই চাই। সেখানেই কথা হয়েছে বেশ কয়েকজন নবীন-প্রবীণ পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের সাথে। প্রসঙ্গত মোটের ওপর বলা যায়, পাঠক, লেখক ও প্রকাশক কেউই খুব একটা সন্তুষ্ট নন। সবারই কম-বেশি অভাব ও অভিযোগ রয়েছে। পাঠকের অভিযোগ, বইয়ের অনেক দাম। এত দাম দিয়ে আমার মতো মানুষের পক্ষে বই কেনা সম্ভব নয়। বইমেলায় অনেক নতুন বই আছে; কিন্তু ভালো মানের বই নেই। কোনো রকম এক, দুই কলম লিখতে পারুক আর না পারুক বই প্রকাশ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে যান। পাঠকরা মনে করেন, বই প্রকাশ করার জন্য লেখকদের এত তাড়াহুড়া করা ঠিক নয়। বরং নিজের লেখার মান বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হওয়া উচিত। একটি লেখা বারবার এডিট করা উচিত। কিন্তু বাস্তবে এমনটা হয় না। ফলে এসব বইয়ের বোদ্ধা পাঠকের কাছে কোনো আবেদন থাকে না।

অবশ্য সম্মানিত লেখকের অভিযোগ আরো গুরুতর। প্রথমত পাঠকের বিরুদ্ধে লেখকের অভিযোগ হলো, পাঠক বই কিনেন না। কিনতে চান না। বেশির ভাগ মানুষ সৌজন্য পেতে চান। একটা বই প্রকাশ করতে একজন লেখককে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়। কিন্তু এই বিষয়টি কেউ ভাবেন না। তা ছাড়া অনেকে এমনো অভিযোগ করেছেন যে, তিনি তার এক বন্ধুকে নিজের লেখা কয়েকটি বই সৌজন্য দিয়েছেন। কিন্তু ক’দিন অবাক হয়ে দেখলেন তার বন্ধুবর বইগুলো একটি পুরনো বইয়ের দোকানে বিক্রি করে দিয়েছেন! একবার ভাবুন তো... একজন লেখকের জন্য এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে! দ্বিতীয়ত, কোনো প্রকাশক তাদের নিজস্ব খরচে নতুন লেখকদের বই প্রকাশ করেন না। করতে চান না। লেখককে নিজের ঘাটের টাকা খরচ করেই বই প্রকাশ করতে হয়। তাও আবার অস্বাভাবিক খরচে! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকাশকরা চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্টসংখ্যক বই দেন না। ১০০ গ্রাম কাগজ দেয়ার কথা থাকলে ৮০ গ্রাম দেন, ৮০ গ্রাম দেয়ার কথা থাকলে ৭০ গ্রাম দেন। অগ্রিম টাকা নেয়ার পরও অনেক প্রকাশকের পেছনে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। মনে হয় যে, অগ্রিম টাকা দিয়ে লেখক মহা অপরাধ করে ফেলেছেন! আমি নিজেও একবার একজন প্রকাশককে অগ্রিম টাকা দিয়ে প্রায় ছয় মাস ঘুরেছি। সেই কষ্টের দাগ এখনো অন্তর থেকে মুছতে পারিনি। তৃতীয়ত, শুধু এখানেই শেষ নয়; প্রকাশকের বিরুদ্ধে লেখকের সবচেয়ে বড় অভিযোগটি হলো, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবীরা কিছু বই কিনলেও প্রকাশকরা লেখককে কোনো রয়্যালটি দেন না। জিজ্ঞেস করলে বরং উল্টো ঝাড়েন, আরে ভাই.. বললাম তো, আপনার কোনো বই বিক্রি হয়নি। আপনার মতো নতুন লেখকের বই কে কিনবে.... ইত্যাদি ইত্যাদি।

অবশ্য প্রকাশকের অভিযোগ আরো গুরুতর। ভাইরে... খুব বিপদে আছি। কাগজ, প্লেট, বাঁধাই, সব কিছুর দাম বেশি। তার ওপর বই কেউ কিনে না.. খালি খরচ আর খরচ... লস আর লস। বললে ভাই আপনিও লজ্জা পাবেন। একটা স্টল নিতে বাংলা একাডেমিকে টাকা দিতে হয়, স্টল চালাতে লোক রাখতে হয়। আপ্যায়ন খরচ আছে। এইসব বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমাদের খরচের টাকাই উঠে না.... ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই যখন বাস্তবতা তখন একজন সামান্য পাঠক হিসেবে, একজন শখের লেখক হিসেবে আমার আর তেমন কিছুই বলার নেই। কিছু বলার থাকতে পারে না। তবুও আমি চাই, আমাদের যে নতুন প্রজন্ম হাতে মোবাইল নিয়ে বড় হচ্ছে; তারা মোবাইলের বদলে বই নিয়ে বড় হোক। আমি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিরুদ্ধে নই। কিন্তু এর অপপ্রয়োগও কম নয়। মাদক যেমন একটা ভয়াবহ সমস্যা; তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তির অপপ্রয়োগও তেমনি একটা ভয়াবহ সমস্যা। আর এই সমস্যা নিরসনে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের রাষ্ট্র, অভিভাবক ও শিক্ষক সমাজকে। নতুন প্রজন্মের মাঝে বইপ্রেম ছড়িয়ে দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বইয়ের বিকল্প কেবল বই।

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
চকরিয়ায় বিরোধের জেরে বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা গাজীপুরে খাদ্যে বিষক্রিয়ায় দুই শিশুর মৃত্যু বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আল্লামা জুলকারনাইনের ইন্তেকাল ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে ‘মিথ্যাচার’ : যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে মামলা উপজেলা নির্বাচন : কেন্দ্রে থাকবে সর্বোচ্চ পুলিশ-আনসার ফেসবুকে ভিডিও দিয়ে মাসে লাখ টাকা আয় আরিয়ান মুন্নার নোয়াখালীতে পানিতে ডুবে দুই ভাইয়ের মৃত্যু বেনাপোলে সামুদ্রিক মাছের ট্রাকে ৪৭০ কেজি চিংড়ি আটক তাপমাত্রা ছাড়িয়েছে ৪৩ ডিগ্রি, লোডশেডিং রেকর্ড ৩২০০ মেগাওয়াট যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করুন : শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিআরটিএ অফিস ঘেরাও করে বিক্ষোভ

সকল