২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

টাকার নকশা টাকার শিল্পী

টাকার নকশা টাকার শিল্পী -


যারা বাস্তবধর্মী কিংবা নির্বস্তুক চিত্র চর্চা করেন, যারা ল্যান্ডস্কেপ চিত্র আঁকেন কিংবা যারা কার্টুন চিত্র আঁকেন তাদের সম্পর্কে প্রায় সবাই জানেন। কিন্তু যারা টাকার নোট নিয়ে ভাবেন, নকশা করেন, স্ট্যাম্পের জন্য চিত্র আঁকেন তাদের কথা খুব একটা জানা যায় না। বাংলাদেশের এমনই একজন শিল্পীর নাম কে জি মুস্তফা। কে জি মুস্তফা বাংলাদেশের বিভিন্ন মূল্যমানের ঢাকার নকশা করেছেন। শিল্পীসৃষ্ট শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ শিল্প দর্শন করেন। শিল্পের রস ও সৌন্দর্য উপভোগ করেন। কিন্তু সুন্দর সুন্দর নকশার সাহায্যে আঁকা টাকা হাতে পেলেই পকেটে বা মানিব্যাগে রেখে দেন। নোটের রস বা সৌন্দর্যের খবরও নেন না। নোট বা টাকার সঙ্গে মানুষের এটিই স্বাভাবিক আচরণ।
শিল্পী কে জি মুস্তফার জন্ম মাদারীপুরে ১৯৪৩ সালে। তিনি ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা কলেজ থেকে কমার্শিয়াল আর্ট বিষয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করেন। শিক্ষা সমাপনের পর তিনি পাকিস্তানের সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে তিন বছর (১৯৬৪-৬৭) সিকিউরিটি ডিজাইনার হিসেবে চাকরি করেন। করাচির এশিয়াটিক অ্যাডভারটাইজিংয়ে সিনিয়র ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন প্রায় এক বছর (১৯৬৭-৬৮)। এরপর ঢাকার ইস্ট এশিয়াটিক অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেডে কাজ করেন দুই বছর (১৯৬৮-৭০)। অর্থাৎ তিনি সব সময়ই কমার্শিয়াল আর্ট বিষয়ে কাজ করেছেন। তিনি তার কাজের একপর্যায়ে ডাক টিকিটের ওপরও বেশ কিছু কাজ করেছেন। এর মধ্যে বিজয় দিবস বিষয়ে কয়েকটি ডাক টিকিট নিয়ে কাজ করেছেন। কাজ করছেন মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে। এসব নকশায় মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় দিবস ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয় বিধৃত হয়েছে এবং এসব মূল্যবান নকশার মাধ্যমে শিল্পী মনের ভাবনাগুলো প্রকাশ পেয়েছে। এসব নকশায় আনন্দ ও বেদনার বিষয়গুলো উঠে এসেছে। যা ১৯৭১ সালের রক্তঝরা দিনগুলোর কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ যুদ্ধের কথা, তাদের আত্মত্যাগের কথা এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ
শিল্পী কে জি মুস্তফা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বেশ কয়েকটি স্ট্যাম্প এবং খামের নকশা এঁকেছেন। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে যারা জীবনপণ যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছেন তাদের মাথার খুলির মধ্য দিয়ে গজিয়ে ওঠা ফুলবৃক্ষ ও ফুলই প্রধান। এখানে ফুল যেমন সুন্দরের প্রতীক তেমনি ক্ষতবিক্ষত মাথার খুলি বেদনার প্রতীক। অর্থাৎ একরাস বেদনার মধ্য দিয়েই ঘটেছে সুন্দরের প্রকাশ। অর্থাৎ শান্তির, প্রশান্তির স্বাধীনতার আগমন ঘটেছে।

আমরা যে সুন্দরের কথা বলি, রসের কথা বলি তার কয়েকটি স্তর আছে। প্রথম স্তরের যে সৌন্দর্যের কথা বলা হয়েছে তাকে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন ফুল, ফল, পাখি ইত্যাদি। একবাক্যে বলা যায় এগুলো সুন্দর। এই সুন্দরের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা নেই। এ সুন্দরের মাঝে তেমন কোনো রহস্যও নেই। যে কারণে এর পেছনে সময় ব্যয় করতে হয় না। সাধনারও প্রয়োজন হয় না সুন্দর বলার ক্ষেত্রে। কিন্তু যদি মানুষ কিংবা মানুষের মুখের কথা বলা হয় তাহলে এর ব্যাখ্যা প্রদান সহজ হয় না যতটা ফুলের ক্ষেত্রে হয়। কারণ মুখ দেখে সহজেই কোনো মত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ মুখের অবস্থা মানুষের হৃদয় গভীরে যে অনুভূতি ক্রিয়া করে তার উপরে মুখের গড়ন বা মুখোভঙ্গির অবস্থা নির্ভর করে। হৃদয়ে আনন্দানুভূতি কিংবা শোকানুভূতি কাজ করলে তারই প্রতিফলন ঘটে মুখে। সুতরাং এ বিষয়ে মতো প্রকাশ করতে হলে ভেবে চিন্তেই প্রকাশ করতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক সূক্ষ্ম বিষয় কাজ করে থাকে। যা সাধারণ দৃষ্টিতে কিংবা সাধারণ জ্ঞানে স্পষ্ট হয় না। যেমন সুন্দর ও মনোহর। সুন্দর ও মনোহর এক নয়, যদিও সাধারণভাবে একই মনে হয়। প্রকৃত অর্থে সুন্দরের অর্থ সঙ্কীর্ণ, কিন্তু মনোহরের অর্থ ব্যাপক বা বলা যায় বহুদূর প্রসারিত। এ কথা বলার অর্থ শিল্পী কে জি মুস্তফার সৃষ্ট নকশাগুলোর মর্মার্থ অনুভব করতে হলে ফুলের সাধারণ সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতার সাহায্যে সম্ভব হবে না। যদিও এখানে ফুলের উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু এ ফুল সাধারণ ফুল নয়। এখানে ফুল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রতীক। সুতরাং এ ফুলের মর্মার্থ অনুভব করতে হলে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযোদ্ধাদের অন্দর মহলে প্রবেশ করতে হবে। যে মহলের খবর সাধারণত অনেকেই রাখেন না। বেশির ভাগ মানুষ যে খবর রাখেন সেটা সদরের খবর। যার কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অন্দর বা অন্দর মহলের খবর দিতে হলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও গবেষণার প্রয়োজন হয়। শিল্পী কে জি মুস্তফার ফুল সাধারণ নয় অন্দরের অসাধারণ ফুল। এ জন্য এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও ভিন্ন।

বাংলা মায়ের দামাল সন্তানরা মা-কে এবং মায়ের মর্যাদাকে রক্ষা করতে গিয়ে যখন নিজেকে উৎসর্গ করে মায়ের মাটির সঙ্গে দেহকে মিশিয়ে দিয়েছেন তখন সেই মাটি হয়েছে উর্বর। আর উর্বর মাটিতে মিশে থাকা কিংবা বলা যায় মায়ের শরীরের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া স্বপ্নের সেই সন্তানদের উর্বর মস্তক (মাথার খুলি) ভেদ করে স্বপ্নের স্বাধীনতা ফুলরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ ফুল অনেক তপস্যার, অনেক ত্যাগের, অনেক কষ্টের। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে যে বীজ বপন করা হয়েছিল সেই বীজ থেকে স্বাধীনতার প্রতীক ফুলকে আত্মপ্রকাশ করতে দীর্ঘ ৯ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। সুতরাং এ ফুল অযত্নে, অবহেলায় প্রকৃতিতে নিজে নিজে গজিয়ে ওঠা সাধারণ ফুল নয়। আর এ জন্যই এ ফুল সৌন্দর্যের কথাই বলে না বলে বেদনার কথাও। এ ফুলকে ঘিরে যে পরিবেশ সেই পরিবেশে শুধু সুবাতাস বয়না। এখানে বাতাস বিলাপ করে। হাহাকার করে প্রবাহিত হয়। বিষাদমাখা স্মৃতির কথাগুলো যেন বাতাসের ছন্দে ভেসে বেড়ায় এখানে। শোকাহত ভারী বাতাসের ক্রন্দন সবার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। আর এ জন্যই অনেকেই এ ফুলকে সাধারণ আর দশটা ফুলের মতোই ভাবেন। আর ফুল হয়ে ওঠে নিছক দর্শনীয় বস্তুতে। শিল্পী কে জি মুস্তফা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে চিত্রগুলো এঁকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। শিল্পীর এই শিল্পকর্ম করা হয়েছে লিথো মাধ্যমে। আকার ৪০দ্ধ২৮.৫ সেন্টিমিটার। এই শিল্পকর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে- The Design the broken skull of a slain martyr, front which a white flower blooms, symbolizes freedom and peace is the fruit of mart Yom the very many whose supreme sacrifice Carved the pathway to a independent Bangladesh. This was the first design of K.G. Mustafa mad during the last week of December 1971, but due to painter's formalities it was differed by one year.'

বিজয় দিবস
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনও দানা বাঁধতে থাকে। এ আন্দোলন আস্তে আস্তে মহাআন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলনে চারু শিল্পীরাও শরিক ছিলেন। বলা যায়, এ আন্দোলনের প্রাণ ছিল চারু শিল্পীদের কর্মকাণ্ড। কারণ অন্য আর যেসব সংগঠন আন্দোলনে যুক্ত ছিল সেসব আন্দোলনের ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, কার্টুন সবই এঁকে দিতেন চারু শিল্পীরাই। একসময় স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন জানাতে ‘বাংলা চারু ও কারু শিল্প সংগ্রাম পরিষদ’ নামক ব্যানার নিয়ে শিল্পীরা রাজপথে নেমে পড়েন। সম্মুখ সারির মেয়েদের হাতে ধরা চারটি বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘স্বাধীনতা’। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। সুতরাং স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস শিল্পীদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। শিল্পী কে জি মুস্তফাও বিজয় দিবস নিয়ে ভেবেছেন। কাজ করেছেন। তিনি বিজয় দিবস অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর নিয়ে বেশ কয়েকটি উদ্বোধনী খাম ও স্ট্যাম্প করেছেন। এগুলো করেছেন বাংলাদেশ ডাক বিভাগের জন্য। বিষয় হিসেবে ব্যবহার করেছেন লাল-সবুজের পতাকা এবং কয়েকটি কবুতর শ্বেত কবুতরদের মুক্ত পরিবেশে মুক্ত আকাশে ওড়াকে বিজয়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। শিল্পীর এই ছবিসংবলিত উদ্বোধনী খাম সম্পর্কে লিখা হয়েছে- The mising sun of hope and aspiration is Illuminating the sky of the future and six free birds, presumably dove are flying joyously. The number of the bids portrays the point programme of Bangladesh Awami League, The party, which first took over the Government of the Country, after the Livaration of Bangldesh.
উপরের বক্তব্যে ছয় দফার যে কথা বলা হয়েছে এবং সেই ছয় দফাকে প্রকাশ করতে ছয়টি কবুতরের ব্যবহারের কথা যে উল্লেখ করা হয়েছে সেটি একটি স্ট্যাম্প। পুরো স্ট্যাম্পজুড়ে ছয় কবুতরের পাখা মেলে উড়বার যে দৃশ্য তা দর্শক হৃদয়কে আন্দোলিত করে। পূর্বে যে উদ্বোধনী খামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেই খামের একটিতে রয়েছে দুটো এবং অন্যটিতে রয়েছে চারটি উড়ন্ত কবুতর। এসব চিত্রও লিথো মাধ্যমে ছাপা হয়েছে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বরকে উপলক্ষ করে।
পক্ষান্তরে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে যে উদ্বোধনী খাম অলঙ্করণ করা হয়েছে সেটি ছাপা হয়েছে ২৫ মার্চ, ১৯৭৩ উপলক্ষে। ২০২৩ সালের ২৫ মার্চ হবে ৫০ বছর। ৫০ বছর পূর্বে অঙ্কিত এসব চিত্র ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। স্মরণ করিয়ে দিবে যুগ যুগ ধরে। শিল্পী কে জি মুস্তফা তার আঁকা উদ্বোধনী খাম ও স্ট্যাম্পের নকশার মাধ্যমে শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্বাধীনতার যে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন তার পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটুক দেশে এই কামনা করি।

 


আরো সংবাদ



premium cement
কলকাতার রাস্তায় চাকরি হারানো শিক্ষকরা শিল্পী-সাংবাদিক দ্বন্দ্ব নিয়ে এলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যশোর কারাগারে হাজতিদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ব্যাপক আতঙ্ক চিকিৎসার জন্য ঢাকা ছাড়লেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু কুষ্টিয়াতে মসজিদ কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ৫ চেয়ারম্যান তপন ও অজিত মেম্বারকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা নারায়ণগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় ১৪ ডাকাত সদস্য গ্রেফতার রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম

সকল