৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


তৃষ্ণা

অলঙ্করণ : জাহিদ হাসান বেনু -

বার্ধক্যের সময়টা কি ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি, নাতবউ, নাতজামাই সবাইকে নিয়ে উপভোগের? নাকি, নানা রোগবালাইয়ের যন্ত্রণা, অস্বস্তি আর বিরক্তি সব মিলিয়ে চরম অভিশাপের। আজকাল একটু সময় সুযোগ হলে সব কিছু ভাবতে শুরু করেন মিনারা বেগম। বয়স সত্তর পেরিয়েছে আরো আগেই। স্বামীকে হারিয়েছেন সেই কবে। ছেলেমেয়েগুলোর লেখাপড়াও শেষ হয়নি তখন। অনেক প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে সংসারটাকে ঠিকঠাকমতো ধরে রেখেছেন। কখনো কোথাও হেলে পড়তে দেননি। লেখাপড়া শেষ করে ছেলেরা যে যার মতো চাকরি-বাকরি, ব্যবসায় ঢুকেছে, যোগ্য ঘর ও বর দেখে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। আজ সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। মেয়েরাও স্বামী সংসার নিয়ে সুখে ব্যস্ত জীবন পার করছে।
ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবতে গিয়ে প্রায়ই আনমনা হয়ে পড়েন মিনারা। সারাটি জীবন মফস্বল শহরে কাটিয়েছেন। সেখানেই বাড়িঘর, সব কিছু। স্বামীর নিজ হাতে গড়া চমৎকার গোছানো বাড়িটিকে এক টুকরো স্বর্গ মনে করে এসেছেন সারাজীবন। জীবনের বড় একটি সময় সেই বাড়িতে কাটালেও বেশ কয়েক বছর ধরে সেই এক টুকরো স্বর্গ ছেড়ে ব্যস্ত জনবহুল রাজধানী ঢাকা শহরে থাকতে হচ্ছে তাকে। ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। ঢাকায় রয়েছে কয়েকজন। তাদের মধ্যে মফস্বল শহরের সেই বাড়িটিতে থাকার মতো কেউ নেই। এই বুড়ো বয়সে মাকে একাকী কোনো কাজের লোক অথবা দূরসম্পর্কের গরিব আত্মীয়ের জিম্মায় রেখে আসতে রাজি নয় ছেলেমেয়েদের কেউই। তারাই অনেকটা জোর করে মাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। এখানে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার উপায় নেই। চার দিকে দমবন্ধ হওয়া পরিবেশ। একধরনের অস্বস্তি মনের মধ্যে চেপে বসে থাকলেও বিভিন্ন ছেলেমেয়েদের বাসায় ঘুরে ফিরে থাকতে থাকতে আজকাল অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি এই জীবনে। মায়ের ভালোমন্দ, সুস্থতা, অসুখ-বিসুখ, ঠিকঠাকমতো ডাক্তার দেখানো, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র খাওয়ানো প্রভৃতি বিষয়ে প্রতিটি বাসার লোকজনের সার্বক্ষণিক নজরদারি থাকে। কারণ একটুখানি অসতর্কতা, অবহেলা কিংবা খামখেয়ালির কারণে মারাত্মক বিপদ ঘটে যেতে পারে। ছেলেমেয়েদের বাসায় গেলে সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সবার এই ব্যস্ততা, মাতামাতি, সতকর্তা, সাবধানতা মাঝে মধ্যে বেশ উপভোগ্য আনন্দময় মনে হলেও আবার তা চরম বিরক্তির, যন্ত্রণাদায়ক, অসহ্য মনে হয় মিনারার কাছে।


এর মধ্যে বেশ কয়েকবার হাসপাতালের আইসিইউ থেকে ঘুরে এসেছেন মিনারা বেগম। চরম সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থেকে মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে এসেছেন। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে তাকে নিয়ে সবার সতর্কতা, সাবধানতা দুশ্চিন্তা আরো অনেক বেড়ে গেছে। তার বয়সী বেশ কয়েকজন, এমনকি বয়সে ছোট মুরব্বি শ্রেণীর আত্মীয় করোনার ছোবলে প্রাণ হারানোর পর থেকে তাকে ঘিরে সবার দুশ্চিন্তা অনেক বেড়ে গেছে। কয়েকবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত অনেক বাড়তি ওষুধ খেতে হচ্ছে। এমনিতেই ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেসার ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের চাপ তো রয়েছে। ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী তার খাবার-দাবার-পথ্যে নানা পরিবর্তন এসেছে। এটা খাওয়া চলবে না, ওটা খেলে ভয়ানক সমস্যা হতে পারে। খাবার-দাবার, পানি সব কিছু নিয়মশৃঙ্খলা মেনে খেতে হবে। এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা না মানায় মারাত্মক বিপদ ঘটে গেছে কয়েকবার। জরুরিভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যখন তিনি যে বাসায় যান, তার সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডার, মাস্ক ইত্যাদিও জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী হিসেবে যায়। শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে যাতে যথাসময়ে এটি ব্যবহার করা যায়।
প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা চলছে এখন চার দিকে। কিছুক্ষণ পরপর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তৃষ্ণায়। ঠাণ্ডা পানি গলায় ঢেলেও তৃষ্ণা মিটছে না যেন। এই গরমে প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা পেলেও কয়েকবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের আইসিইউ ঘুরে আসা মিনারার জন্য ডাক্তারের নির্দেশ আর পরামর্শে সারা দিনে মাত্র দেড় লিটার পানি নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। তার জন্য অতিরিক্ত পানি পান করাটা বিপজ্জনক। কারণ বেশি পানি খেলে ফুসফুসে তা জমে মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। ডাক্তারদের তেমন নির্দেশনার পর থেকে মিনারার জন্য দৈনিক মাত্র দেড় লিটার পানি বরাদ্দ করা হয়েছে। এর বেশি পানি খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই তার। তৃষ্ণায় বুকের ভেতরটা খা খা করলেও বাড়তি পানি খাওয়া বারণ। প্রতিবেলায় নাশতা, ভাত কিংবা ওষুধ খাওয়ার সময় তাকে গ্লাসের অর্ধেকেরও কম পরিমাণ পানি দেয়া হয়। তৃষ্ণা মেটাতে আরো পানি দরকার তার- অনেকবার বলেছেন ছেলেমেয়ে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনিদের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কেউই তার অনুরোধ, আবেদনে সাড়া দেয় না।


অতিরিক্ত পানি খেলে আবার আপনার লাংসে পানি জমবে, নিউমোনিয়ার ভয়াবহ আক্রমণ হবে, আইসিইউতে ছোটাছুটি করতে হবে আপনাকে নিয়ে, আপনি কি আবার সেখানে যেতে চান- কড়া ধমক দিয়ে বলেছে বড় মেয়ে রিমি।
মেয়ের ধমকের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মিনারাও বলেছেন, আমাকে তোরা কী পানি না খাওয়াইয়া মাইরা ফালাইবি?
কেন আপনার যতটুকু পানি খাওয়া চলবে, ততটুকুই খেতে হবে। এর বেশি খেলেই বিপদ হবে, বুঝতে পারছেন না কেন? রিমি বলেছে রেগেমেগে।
মিনারাও কম যান না। আপন কন্যার নির্মম আচরণে ফুঁসে উঠেছেন। ‘আরে, তোরা আমাকে কি বোঝাস। পানির আরেক নাম জীবন, জানস না। আমি এখন আমার মন ভইরা পানি খাইতে পারি না। এভাবে বাঁইচ্যা থাকতে পারমু না আমি।
‘পানির আরেক নাম জীবন- কথাটা আপনার বেলায় উল্টো হয়ে গেছে আম্মা। পানি আপনার জন্য বিষ হইয়া গেছে জানেন না, ডাক্তাররা বারবার নিষেধ করেছে অতিরিক্ত পানি খাওয়া চলবে না আপনার। আপনি কী আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চান। আমরা আপনাকে এভাবে মরতে দিতে পারি না, আম্মা।
মাগো, এভাবে তো আর পারি না। পানির তৃষ্ণায় বুকের ভেতরটা কেমন জানি খা খা করে। গলাটা কেবলই শুকাইয়া আসে। জীবনডা অনেক কষ্টের মনে হয়। আল্লাহর দোহাই লাগে, আমারে আমার মন ভইরা পানি খাইতে দে তোরা, আর্তনাদ ঝরে পড়ে মিনারার কণ্ঠে।
মায়ের আর্তনাদ দেখে মায়া হলেও কিছুই করার নেই যেন কন্যার। রিমিও মায়ের কষ্টটা অনুভব করে। তার মনটা কেমন করে মায়ের জন্য।
বাসায় তার ওপর কঠোর নজরদারি চালু করা হয়েছে। কারণ বেশ কয়েকবার সবার অগোচরে রান্নাঘরে ঢুকে লুকিয়ে পানি খেতে গিয়ে হাতে-নাতে ধরা পড়েছেন তিনি। তখন কড়া ধমক শুনতে হয়েছে। কলেজ পড়–য়া নাতি সাকির তার নানুকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে নানাভাবে।
নানু, তুমি কি আমাদের ভালোবাসো না? তুমি কি আমাদের ছেড়ে যেতে চাও? বেশি পানি খেলে তোমাকে আবার হাসপাতালে যেতে হবে, আমরা তো সেটা হতে দিতে চাই না।

নাতির কথা শুনে চুপ হয়ে গেছেন মিনারা। তাকে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থেকেছেন। সাকিরকে কিভাবে বোঝাবেন, এই বুড়ো বয়সে অনেক বাবা-মা খাবার-দাবার, ওষুধ-পথ্য, আশ্রয়ের অভাবে অনেক কষ্টে, দুশ্চিন্তায় অসহায় জীবনযাপন করছে। তার হয়তো সেই কষ্ট নেই। কিন্তু তৃষ্ণা মেটাতে তার যতটুকু পানি খেতে মন চায় তা খাওয়ার স্বাধীনতা নেই। অথচ পানির জন্য বুকের ভেতরটা সবসময় কেমন খা খা করে। মরুভূমির মতো শুকিয়ে থাকে।
এ জীবনটা বড় বিচিত্র, অনেক অদ্ভুত। ছেলেমেয়েদের আদরযতœ, ভালোবাসা, নাতি-নাতনিদের অনেক ভক্তি-শ্রদ্ধা, আদর, ভালোবাসায় এখন ভরে আছে তার জীবনটা। কোনো অপূর্ণতা কিংবা অসন্তুষ্টি নেই। এই বয়সে চেনাজানা অনেককেই অযতœ, অবহেলায়, অসহায়ভাবে একাকী কষ্টকর জীবন পার করতে হচ্ছে। কাউকে কাউকে বৃদ্ধাশ্রমেও থাকতে হচ্ছে অনেক দুঃখ-বেদনাকে সঙ্গী করে। তেমন অবস্থা হয়নি তার। এ জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতি প্রার্থনায় কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করেন না মিনারা। অথচ শারীরিক অসুস্থতা ঠেকাতে ডাক্তার এ কোন নির্মম আদেশ জারি করেছে তার জন্য। এভাবে আর কত দিন চলবে, কে জানে। এভাবেই কী তাকে বাকি জীবনটা পার করতে হবে- প্রশ্ন করেন নিজেকে। আসলে একজন মানুষের জীবনে সুখ পরিপূর্ণভাবে ধরা দেয় না। সব কিছু পেলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপূর্ণতা থেকে যায় যেকোনোভাবে। নিজের জীবন দিয়ে সেটা উপলব্ধি করেন মিনারা বেগম।

 


আরো সংবাদ



premium cement