১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলকদ ১৪৪৫
`


কল্যাণব্রতের কবি আফজাল চৌধুরী

কল্যাণব্রতের কবি আফজাল চৌধুরী -

আফজাল চৌধুরী একাধারে কবি, শিক্ষক, সুপণ্ডিত, সমালোচক, ওজস্বী বক্তা সর্বোপরি একজন নির্ভীক সৈনিক। এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষটি জীবনে নানা পেশার নানা দায়িত্ব পালন করলেও তিনি বারবার ফিরে এসেছেন তাঁর মূল কর্মক্ষেত্রে। সে ক্ষেত্রটির নাম সাহিত্য। সাহিত্যই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান উপজীব্য। তাঁর ওজস্বী বক্তব্য মানুষকে মোহগ্রস্ত করে তুলত। তিনি যা বিশ্বাস করতেন অকপটে তা সবার কাছে প্রকাশ করতেন। তাঁর চিন্তাচেতনা ও কর্মে অভূতপূর্ব সঙ্গতি ছিল যা সত্যিই বিস্ময়কর। বিশ্বাসের পক্ষে আধ্যাত্মিক চেতনাসমৃদ্ধ সাহিত্য আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্ব এবং ইসলামের প্রতি গভীর অনুরাগ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। যারাই তাঁর সান্নিধ্যে আসতেন, সবাই তাঁর সাথে আলাপচারিতায় মুগ্ধ হতেন। সবাইকে তিনি আপন করে নিতেন মুহূর্তের মধ্যে। ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা তাঁর চিন্তাচেতনার কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে জুড়ে থাকত এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা অটুট ছিল।
ছাত্রজীবনে লিটল ম্যাগাজিনে গল্প লেখার মাধ্যমে তাঁর সাহিত্যাঙ্গনে পদচারণা শুরু। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কল্যাণব্রত’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। এটা ছিল কাব্যজগতে তৌহিদের পক্ষে একটি বিপ্লবী গ্রন্থ। ‘বলিও আমার প্রেম ঈশ্বরের ভস্ম নয় ভূমা’ এই বিপ্লবী উচ্চারণের মাধ্যমে তিনি কলাকৈবল্যবাদীদের চিন্তায় মোক্ষম আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই থেকে বিশ্বাসের সপক্ষে তার পদচারণা শুরু। দুর্গম এই পথচলার যতটা না বাহবা পেয়েছেন তার চেয়ে বেশি পেয়েছেন অপবাদ, শত্রুতা, অবহেলা। কিন্তু কোনো কিছুই আফজাল চৌধুরীকে তাঁর একনিষ্ঠতা থেকে ফেরাতে পারেনি। সব কিছুই খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে। ‘শিরদেগা নাহি দেগা আমামা’-এই ছিল তাঁর দর্শন, যা তিনি আমৃত্যু ধারণ করেন।
১৭৯৪ সালে ‘সামগীত দুঃসময়ের’ কবিতাটি ইত্তেফাকের রবিবাসরীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপকভাবে পঠিত হয় এবং পাঠকমহলে সাড়া জাগে।
কবিরা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন। আফজাল চৌধুরীও এর ব্যতিক্রম নন। এই স্বপ্ন দেশ ও জাতিকে ঘিরে আবর্তিত। তিনি তাঁর দেশ ও কাল সম্পর্কে সচেতন এবং রাজনৈতিক একটি চিন্তাধারা তিনি প্রগলভ প্রচারক।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎবসু, আবুল হাসিম ও মওলানা ভাসানীর নিখিল বাংলা ও আসামকে সংযুক্ত করে এক দেশ সংগঠনের উদ্যোগের তিনি অধঃস্তন লালনকারী। নওয়াব সলিমুল্লাহকে তিনি এই স্বপ্নের মূল হোতা মনে করেন। তিনিই তার এই স্বপ্নের সম্ভাব্য দেশটিকে একটি নামকরণও করেছেন। ‘বাংলাসাম’ হলো তার এই নাম।
কবি আফজাল চৌধুরীর বেশ কিছু প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। ‘কল্যাণব্রত’, ‘হে পৃথিবী নিরাময় হও’, ‘শ্বেতপত্র’, ‘সামগীত দুঃসময়ের’, ‘ঐতিহ্য চিন্তা ও রসূল প্রশস্তি’, নয়া পৃথিবীর জন্য, শবমেহেরের ছুটি, বিশ্বাসের দিওয়ান, সিলেট বিজয়, তাঁর কাব্যলোকে সৈয়দ আলী আহসান ও বার্নাবাসের বাইবেল এই কয়টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাকি বইগুলো প্রকাশের অপেক্ষায়, সিলেটের সুফি সাধনা, নান্দনিক ভুবন, মক্কার পথ; মুহাম্মদ আসাদের মহাজীবন, নাটিকা : ক্ষুদিত ক্যাম্পাস, ‘বন্দী আরাকান ও অন্যান্য কবিতা, অন্য গোলার্ধে হৃদয়, খোশহাল খান খটকের জন্য পঙ্ক্তিমালা, শাশ্বতের পক্ষে কবিতা, বাঁশি, অনুবাদ কবিতার মধ্যে রয়েছে জালালুদ্দীন রুমীর কবিতা ও আলী শরিয়তীর কবিতা। প্রবন্ধ : কবিতার সংসারে জটিলতা, প্রতিশ্রুত কথকথা ইত্যাদি। বায়তুল মোকাররমের তৎকালীন খতিব মরহুম ওবায়দুল হকের সহায়তায় তিনি ১০ পারা কুরআন শরিফ অনুবাদও করেন।
আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে কবি আল মাহমুদকে নিয়ে ‘আফগানিস্তান আমার ভালোবাসা’ নামে তার একটি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্কলন ১৯৮০ সালে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশ করা হয়। এ প্রসঙ্গে কবি আল মাহমুদের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য ‘আমাদের যৌথ সম্পাদিত গ্রন্থ হলেও এ সঙ্কলনের প্রায় পুরোপুরি দায়িত্ব পালন করেছেন কবি আফজাল চৌধুরী। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ গ্রন্থটির সমতুল্য কোনো গ্রন্থ পাওয়া হবে কষ্টকর।’
ঐতিহ্য নামক একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকাও ঢাকা থেকে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ঐতিহ্য চিন্তা ও রাসূল প্রশস্তি গ্রন্থে ইসলামের অভ্যুদয় থেকে বাংলাদেশে ইসলামী সভ্যতার পূর্ণ প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত এবং সেখান থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত যে সাংস্কৃতিক ধারার উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে তার ব্যাখ্যা ও সূত্র নির্ধারণ এবং গতি-প্রকৃতির নিপুণ বিশেষণ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবেলায় সমকালীন যুবশক্তিকে উজ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষিত এবং রেনেসাঁর আলোক নির্দেশ করা হয়েছে।
আফজাল চৌধুরী অনূদিত ‘বার্নাবাসের বাইবেল’ গসপেল অব বার্নাবাসের অতি সফল প্রথম অনুবাদ। এই গ্রন্থটিই যে মূল ইঞ্জিল কিতাব এ কথা এখন প্রায় স্বীকৃত। গ্রন্থটি ব্যাপকভাবে আমাদের পাঠক সমাজের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে।
কবি আফজাল চৌধুরী ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ হবিগঞ্জ শহরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস বাহুবল থানার খাগাউড়া গ্রামে। তার পিতার নাম প্রফেসর মাওলানা আবদুল বসীর চৌধুরী এবং মাতার নাম সৈয়দা ফয়জুন নেসা খাতুন। তার পিতা আবদুুল বসীর চৌধুরী টাইটেল পাস করে অনার্সসহ বিএ পাস করেন এবং আরবিতে এমএ পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আবদুল বসীর চৌধুরী হবিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলে হেড মাওলানা, ঢাকা সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের লেকচারার এবং সলিমুল্লাহ কলেজে ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এ্যাংলো অ্যারাবিক গ্রামার এবং এ্যাংলো অ্যারাবিক ট্রান্সলেশন নামক দু’খানি পাঠ্যপুস্তকও রচনা করেন। নবাব সলিমুল্লাহর উৎসাহে তিনি ইংরেজিসহ উচ্চশিক্ষা লাভ করেন।
আফজাল চৌধুরীর মা সৈয়দা ফয়জুন নেসা খাতুন ছিলেন মাধবপুর থানার ইটাখলা নিবাসী বিশিষ্ট জমিদার সৈয়দ শফি উদ্দিনের কন্যা এবং দানবীর ও রাজনীতিবিদ সৈয়দ সঈদ উদ্দিনের বোন। সৈয়দ সঈদ উদ্দিন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি। প্রফেসর কবি আফজাল চৌধুরীর পূর্ব পুরুষ ঐতিহাসিক ফকির বিদ্রোহের ফকির বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মজনু শাহ মস্তানের পুত্র পরাগল শাহ ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মগোপন করেন, পরে নবীগঞ্জ উপজেলার রুকনপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। আত্মগোপনকারী পরাগল শাহ নাম পরিবর্তন করে নিজ নাম রাখেন শেখ নজির। তিনি দু’পুত্রের জনক। তার পুত্ররা হলেন শেখ ধনাই ও শেখ মনাই। শেখ ধনাই ও শেখ মনাই স্বীয় বুদ্ধিবলে অনেক ভূ-সম্পত্তির মালিক হন। তাদের নামে দু’টি তালুক আছে।
কবির কর্মজীবনের সূচনা হয় সরকারি কলেজের প্রভাষক হিসেবে তৎকালীন রাজশাহী সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে। পরবর্তীকালে সিলেট এমসি কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, আবার সিলেটের এমসি কলেজের বাংলা বিভাগে তিনি অধ্যাপনা করেন। সেখান থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যোগদান করেন এবং সিলেটের কেন্দ্রটি তার হাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সিলেট থেকে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ড বিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকেন। অতঃপর তিনি সিলেট মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবেও কর্মরত থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এমসি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে ১৯৯০ থেকে ’৯৫ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এই সময়ে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৯৬ সাল থেকে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করে ১৯৯৯ সালের প্রথম পাদে অবসর গ্রহণ করেন।
কবি আফজাল চৌধুরী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঢাকা বিভাগের পরিচালক থাকাকালে ১৯৮৪ সালে মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটিং প্রোগ্রামে এক মাসব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটটি রাজ্য সফর করেন।
৯ জানুয়ারি ২০০৪ স্থানীয় একটি ক্লিনিকে সন্ধ্যা ৪.৪০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লেখক : কবি আফজাল চৌধুরীর একমাত্র কন্যা

 


আরো সংবাদ



premium cement
আরো ৩ জাহাজে হামলা হাউছিদের জেলেনস্কিকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে উত্তাল ইউক্রেন ‘শয়তানের নিঃশ্বাস‘ নামের যে ড্রাগ প্রতারণায় ব্যবহার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে মার্কিন বিমানবাহিনীর সদস্য নিহত পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বিএনপির সমাবেশ শুরু টঙ্গীতে ৩ তলার ছাদ থেকে পড়ে বিএনপি নেতার ছেলের মৃত্যু মালদ্বীপ থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করেছে ভারত জামিন পেলেন কেজরিওয়াল, তবে ভোটগণনার দিন থাকতে হবে জেলেই পরকীয়া প্রেমিক যুগলের গলায় জুতার মালা : চেয়ারম্যান বরখাস্ত সমাবেশে যোগ দিতে নয়াপল্টনে জড়ো হচ্ছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা রংপুরে রেয়াত পদ্ধতি চালুসহ ৪ দফা দাবিতে মানববন্ধন

সকল