৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


স্বপ্ন বিভোর হাসি

-

মাথাটা ধরে আসছে মুনজিরিনের। এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে বড়ই বিষণ্ন মনে হচ্ছে নিজেকে। একটু প্রশান্তি পেতে আজ তার অনেক কথাই মনে পড়ছে। কিন্তু সবই যেন রূপকথার গল্প। সান্ত¡না পাবার মতো কিছুই নেই। এসব ভাবতে ভাবেতে মাথাটা আরো ধরে এলো। একটা এসপিরিন নিমেষেই ঢক করে গিলে নিলো সে। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। আরো একটা খেয়েছে। তবুও ব্যথার তীব্রতা কমেনি। মুনজিরিন বুঝতে পারল, এর নিরাময় ওষুধে নয়। যা করা উচিত, তা তার পক্ষে দুরূহ ও হাস্যকর। রাতের আকাশে চাঁদের ঝলকানি মুছে গেছে। ভোরের আভা ফুটে উঠেছে। তবুও এখনো ঘুমে চোখ বুজে আসছে। শরীরটা এদিকে-ওদিকে ঢলে পড়ছে। শাশুড়ি তাকে হাঁক ছেড়ে ডাকছে। এই অভাগী, ওঠ। উঠছিস না কেন। আর ঘুমিয়ে কাজ নেই। অনেক কাম পড়ে আছে।
ফজরের আজান হয়েছে। চার দিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। লোকের আনাগোনাও শুরু হয়েছে। রাখাল গরু নিয়ে মাঠে নামছে। কৃষাণ-কৃষাণীও কাজে লেগে পড়েছে। ভোরের এই ঝাপসা আওয়াজগুলো ভেসে আসছে তার কানে। জেগে ওঠার প্রয়োজনও অনুভব করছে। তবু আবারও সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কী এক মিষ্টি গন্ধ! এ এক দুর্দান্ত স্বাদ। তার বহু দিনের চেনা মানুষটি। আজ এক ভিন্নরূপে ধরা দিয়েছে। বাইরে ঝলমলে রোদ। কচি-কাঁচার হইহুল্লোড়। শাশুড়ি এসে বলল- এই মুনজিরিন, কখন সকাল হয়েছে সেদিকে খেয়াল রাখিস। ওদের ফেরার সময় হলো যে। কী খেতে দিবি ওদের। ওদিকে তোর শ^শুরটা চেঁচিয়ে মরছে। বুড়ো বয়সে এই লোকটার ভিমরতি হয়েছে। বউয়ের আঁচলে মাথা গোঁজার সখ হয়েছে উনার। বয়সের কালে সুন্দরী মেয়েদের পেছনে পড়ে রয়েছে। আর এখন বউয়ের প্রতি সোহাগ দেখানো হচ্ছে। যা, এখন ওদের দু-চারটাকে গিয়ে নিয়ে আয়। ওরাই তোর দেখভাল করবে।
বেশ কদিন ধরে সময়টা ভালো যাচ্ছে না মুনজিরিনের। কী সব দুশ্চিন্তা। মাথায় একথা-ওকথা উঁকি মেরে যায়। কাছের মানুষ দূরে থাকলে এ এক বড় কষ্ট। জীবনের বহমানতা থমকে দাঁড়ায়। সবই হয়ে যায় এলোমেলো। মুনজিরিন সংসার জীবনে পা রেখেছে এখনো একটি বছর হয়নি। তাতেই জীবন নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। জীবনের এই বহুমাত্রিকতা তার কল্পনার বাইরে এক বৃহৎ জগৎ। যেখানে বাস্তবতা এসে জড়ো হয় ভিন্ন সব অভিজ্ঞতা নিয়ে।
জীবন বড়ই বিচিত্র! তার চেয়েও বিচিত্র সমাজের মানুষগুলো। কখনো কখনো মুনজিরিনের মনে হয়, জীবনের এই বৈচিত্র্য আছে বলেই মানুষের এত রূপ, এত রস। মানুষ কখনো নিজে সুখী হতে চায়। আবার কেউবা অন্যকে সুখী করতে চায়। কত আজব এই মানুষ! মানুষে মানুষে কত তফাৎ। কেউ প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে আপনজনকে ভুলে যায়। এক বৃহৎ স্বার্থে নিজেকে কোরবান করে। মুনজিরিন ভাবে, সঙ্গী হিসেবে যাকে বেছে নিয়েছি সে আর দশটি মানুষের মতো নয়। তার চিন্তা ও আদর্শে সে এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। সে আমার প্রয়োজন বোঝে না তা নয়, প্রায়োগিক জীবন তাকে এক ভিন্ন ধারার মানুষে পরিণত করেছে। তার কাছে আমার ভালোবাসার মূল্য থাকলেও জীবনের পুরোটা অধিকার আমি নিয়ে নিতে পারব না। জীবন কখনো এক কেন্দ্রিক হয় না। হলেও সেখানে হাসি-কান্নার এমন কিছু খেলা জড়িয়ে থাকে যা ব্যক্তিকে প্রতি পলে পলে অসহায় আর নির্জীব করে রাখে। একটি চঞ্চল মানুষকে অস্তাচলে ঢুবিয়ে মারা জীবনপ্রিয় মানুষের ধর্ম হতে পারে না। অন্যের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখাই জীবনের ধর্ম।
ইমরানের কথা খুব মনে পড়ছে। কীভাবে ছয়টি মাস কেটে গেল। আত্মত্যাগের এক অনুপম দৃষ্টান্ত ইমরান। নিজেকে মানবতার কাছে সোপে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মুনজিরিনের বিবাহিত জীবনের একটি বড় অংশ আজ অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির দোলাচলে সে এক সংকটময় পরিস্থিতির শিকার। মাঝে মাঝে খুবই অসহায়ভাবে নিজেকে। ইমরানের স্মৃতিগুলো খুবই আলোড়িত করছে তাকে। বৈবাহিক জীবনের একান্ত প্রাপ্তি তাকে হতাশার দ্বারে উপনীত করেছে। সে বড়ই ভয় করে নিজেকে নিয়ে। সংযমের সংকীর্ণ রশি কখন না ছিড়ে যায়। চলমান জীবনের গতিপ্রবাহে নিজেকে আড়াল করে রাখা তার কাছে ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠছে। মনের দিক থেকে যদিও সে দুর্বল নয়, তবুও এমনি এক চিন্তা মনে উদিত হচ্ছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রভাবকে সে মোটেই অস্বীকার করতে পারে না।
চাকরি জীবনে ইমরানের বাবা দু’হাতে কামিয়েছে। কখনো ডানে-বামে তাকায়নি। শোনেনি বিবেকের শাসন। বারণ। চেয়েছে শুধু চাকচিক্যময় জীবন। তা সে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও ইমরানের মা কখনো এর জন্য লালায়িত ছিল না। অল্পতেই তুষ্ট থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে স্বামীর ইচ্ছেকেই তার মেনে নিতে হয়েছে। তবুও কী হলো! শেষপর্যন্ত সব হারিয়ে আজ নিঃস্ব প্রায়। ভিটে-মাটি সব কেড়ে নিয়েছে প্রাণঘাতী ক্যান্সার। তবুও জীবন কোথায় গিয়ে যে থমকে দাঁড়াবে তা আজো বলতে পারে না কেউ।
ইমরান বাবার কিছুটা গুণ পেয়েছে। সহজসরল ও অনাড়ম্বর জীবন তার কাছে অর্থহীন। পরিবারের অনেক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও সে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারেনি। হতে চায়নি। বাবার জৌলুসে মুগ্ধ ছিল সে। উচ্ছৃঙ্খল জীবন তাকে এক অন্য মানুষে পরিণত করেছে। শেষজীবনে নিজের বোধোদয় হয়েছে ঠিকই কিন্তু আত্ম রক্ষা হয়নি।
নিজের একটি ছোট্ট সিদ্ধান্ত আজ তার জীবনে সমস্যার একটি বড় আকার ধারণ করেছে। যে সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সবসময় ঘুরপাক খায় মুনজিরিন। যে অপরাধে শুধু মুনজিরিন দায়ী নয়, ইমরানও সমঅপরাধী। মুনজিরিন একটি বিষয় সবসময় অনুভব করে, বিত্তশালী কোনো পরিবারে বিত্তহীন কোনো মেয়ের অনুপ্রবেশ কেবল লজ্জারই নয়, বরং অপমানেরও। আড়ালে-আবডালে তাকে অনেক কথা হজম করতে হয়। নিজের ভুল সিদ্ধান্ত আর বোকামিকে মেনে নিয়ে পিতামাতাকে আর অসম্মান করতে চায় না মুনজিরিন। নিয়তির কাছে নিজেকে ছেড়ে এখানেই খুশি থাকতে চায়। এর চেয়ে বেশি কিছু সে আর ভাবে না। ভাবতে চায়ও না। কারণ পিতামাতার অবাধ্য হওয়া কম অভিশাপ নয়।
কিছু একটা নিয়ে প্রায়ই ইমরানের সাথে ওর বাবা-মার কথা হয়। কখনো সেটা ঝগড়াতেও রূপ নেয়। স্বামী হিসেবে ওকে যতটা মন্দ বলা যায় আসলে মানুষ হিসেবে ও ততটা মন্দ নয়। সবই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। কিছু দিনের ভেতর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠল। জানার পরে এতটা কষ্ট হলো যতটা না আমাকে নিয়ে তার চেয়ে বেশি বাবাকে নিয়ে। আমি এমন একটা মেয়ে যে তার বাবার আত্মসম্মান নষ্ট করে তাকে হাসির খোরাকে পরিণত করেছি। আর যারা তাকে নিয়ে তামাশা করছে তাদেরও অবহেলা করতে পারছি না। কারণ তারা আমার আত্মীয়। তাদের সাথে এক নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে গেছি।
মাথাধরা এখন আর নতুন কিছু নয়। দেরি করে ঘুমানোটা আমার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেল। তবে অন্যদিনের চেয়ে আজকে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েই পড়লাম। এতটা আবেগতাড়িত আমি কখনো হইনি। আজকে আমার মধ্যে সেই ভাবটাই কাজ করছে। এ নিয়ে একটু বিব্রত হলাম বটে। তবে খুব একটা আমলে নিলাম না।
রাতে স্বপ্ন দেখা আমার এক অভ্যেস। যার সিংহভাগ মিথ্যে হয়। ইমরান এক উঁচু পাহাড় থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ছে। আমি বেগবান গতিতে ওর দিকে দৌড়ে গেলাম। আমি বললাম- ইমরান, তুমি এমন করছো কেন? এ অন্যায়। এর চেয়ে জঘন্য পাপ আর কী হতে পারে! তুমি এদিকে এসো। সময় ও পরিস্থিতি সবই একদিন ঠিক হয়ে যাবে। দুঃখকে সঙ্গী করে নাহয় আরো কিছুদিন একসাথে বাঁচব। তাতেই-বা কী এসে যায়। তাই বলে এমন করবে? আমার কথা একটুও ভাববে না?
ইমরান আমার দিকে ফিরে তাকাল। ওর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। আমি এ দৃশ্য দেখে মোটেই মেনে নিতে পারলাম না। আমার বাক রুদ্ধ হয়ে এলো। জ্ঞান হারাতে বসলাম। তবুও নিজেকে সংযত রাখলাম। আমার চিৎকারে ঘরের সবাই জেগে উঠল। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি-সবাই আমার চারপাশে। সবার মনে হচ্ছে, আমি বড্ড উল্মাদ! আমার দিকে ওভাবেই সবাই তাকাচ্ছে।
হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে শাশুড়ির জোরে চিৎকার ভেসে আসছে। লোকজন ছুটে এলো। আমিও অবাক হলাম। আমি না হয় স্বপ্ন দেখেছি। মা কী দেখেছেন। তার ছেলেকে তাদের অমতে বিয়ে করেছি বলে আজ আমাকে এত কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে হারানোর সংশয় নিয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে। মার তো হারানোর কিছু নেই। হতে পারে বাবা অসুস্থ।
তাকিয়ে দেখি, তারা একে অপরকে কী যেন বলছে। কিন্তু সে কথা আমার কান পর্যন্ত আসছে না। আমাকে তারা সে কথা শোনাতেও চায় না। তবুও ওদের একজন এগিয়ে এসে বলল, ‘অভাগী সবই তো হারালি। আর কী-ইবা বাকি রইল। এখন আর নিজেকে ছোট করিস না, আত্মসম্মান নিয়ে নিজে একটু বাঁচ। আর বাপাকেও বাঁচতে দে।’
আমি কিছুই বুঝলাম না। তবে কিছু যে একটা হয়েছে তা আঁচ করতে পারলাম। ঠিক তখনি আমার মোবাইলে একটা ক্ষুদে বার্তা এলো। ‘ইমরান ইজ নো মোর।’ আমি বার্তাটি পেয়ে মুষড়ে পড়লাম। তবুও ফোনটি হাতে নিয়ে কথা বলতেই আমি আরো আঁতকে উঠলাম। এরপর যা হলো সবই ভয়ঙ্কর। মরা মানুষের কথা শুনে আমি আর হাসি ধরে রাখতে পারলাম না। আমার অট্টহাসি দেখে সবাই রীতিমতো চমকে গেল। বিজয়ের এক মহাহাসি ফুটে উঠল আমার দু-ঠোঁটে। এ এক নতুন আশা জাগানিয়া স্বপ্ন বিভোর হাসি।


আরো সংবাদ



premium cement