২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সাহিত্যে বর্তমান সঙ্কট

-

সাহিত্য আর বিজ্ঞান কখনোই প্রতিপক্ষ নয়। যদিও একশ্রেণীর মানুষ এমনটাই মনে করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান ও সাহিত্য একে অন্যের সহায়ক। কোনো একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য একক কোনো বিষয় দায়ী হতে পারে না। এর সাথে জড়িয়ে থাকে একাধিক বিষয় ও হেতু। অনেক লেখক সাধারণ মানুষের বই বিমুখিতার জন্য সচারাচর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নকে দায়ী করে। বর্তমান সময়ে এমন ভাবনা হয়তো যৌক্তিক; কিন্তু ধারণাটি ত্রুটি মুক্ত নয়। পাঠ্য বই ব্যতিরেকে বইয়ের সাথে (এক্সট্রা বই) অর্থাৎ সাহিত্যের সাথে মানুষের সম্পর্ক কমে যাওয়া বা মানুষের বই না পড়ার কারণ কিছুটা হয়তো প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বা ইন্টারনেট-ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা; কিন্তু এটা কখনোই একমাত্র কারণ নয়। উন্নত প্রযুক্তির কারণে সাহিত্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ হয়তো কিছুটা কমেছে; কিন্তু তার জন্য যে শুধুই প্রযুক্তি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দায়ী তা একদমই সঠিক নয়। এই বিষয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই খতিয়ে দেখা উচিত সাহিত্যের প্রতি মানুষের আসলেই আকর্ষণ কমেছে কি না? আমি বিষয়টি নিয়ে সামান্য গবেষণা করে দেখেছি, সাহিত্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কিছুটা কমেছে ঠিক; কিন্তু আমরা এর হারটা যতটা ভাবি ঠিক ততটা নয়। নব্বইয়ের দশকের সাহিত্যের পাঠকের হারের সাথে বর্তমান সময়ের পাঠকের হারের সংখ্যা কম হলেও পার্থক্য সামান্য। জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে বিষয়টি প্রত্যক্ষ চোখে দেখা না গেলেও সাহিত্যের পাঠকের সংখ্যা এখনো কিন্তু নিতান্তই কম নয়। কিন্তু এটা সত্যি যে পার্থক্যের হার যেমনই হোক না কেন, গড়ে সাহিত্যের পাঠকের সংখ্যা যে কমছে এটা তো সত্যি। এখন দেখতে হবে এমনটা কেন হচ্ছে? সাহিত্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কেন কমছে? কেন লেখক ও পাঠকের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে? এসব প্রশ্নের একাধিক জবাব আছে। প্রথমেই বলতে হয় ভালো সাহিত্যের পাঠক আগেও ছিল এখনো আছে; কিন্তু সাহিত্যিকের সংখ্যা আগে কম ছিল এখন বেড়ে গেছে; আর কমে গেছে সাহিত্যিকদের কদর। সাহিত্যের পাঠক কমে গেছে তাই সাহিত্যিকদের কদর কমে গেছে বিষয়টি মোটেও এমন নয়। সাহিত্যিকদের কদর কমে যাওয়ার জন্য মূলত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী দায়ী। সাহিত্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ দিন দিন কেন কমছে, কেন লেখক পাঠকের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে? এসব প্রশ্নের জবাবে বলতে হবে লেখকদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা, সাহিত্যকে আনুষ্ঠানিক উৎসাহ প্রদান না করা, অবহেলা করা বা যোগ্যদের যোগ্যতার দাম না দেয়া লেখক ও পাঠকের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য দায়ী। সাহিত্যে যথাযথ মূল্যায়ন না থাকার কারণে প্রতিভাধর লেখকরা সাহিত্য থেকে দূরে সরে থাকে। সাহিত্যের মাঠ থেকে প্রতিভাধর লেখকদের অনুপস্থিতির ফলে যুগান্তকারী কোনো সৃষ্টি সৃজন হচ্ছে না, ফলে জন্মও নিচ্ছে না রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের মতো নতুন ইতিহাস সৃষ্টিকারী কোনো লেখক কিংবা যুগান্তকারী কোনো রচনা। অল্পস্বল্প ভালো সাহিত্য যা আসছে সঠিক মূল্যায়নের অভাবে তা-ও থাকছে লোক চক্ষুর অন্তরালে। ফলে সাহিত্যের পাঠকরা আটকে আছে পুরনো সাহিত্যে। বর্তমান পাঠক সমাজ ধরেই নিয়েছে এ সময়ে ভালো কোনো সাহিত্যের জন্মই সম্ভব না, এর ফলস্বরূপ সৃষ্টি হচ্ছে নতুন লেখকও পাঠকের মধ্যে দূরত্ব। আবার যেসব প্রতিভাবান লেখক অনেকটা সাহস নিয়ে মাঠে আসছে তারাও পাঠক ও মূল্যায়নের অভাবে অসময়েই ঝরে যাচ্ছে, ফলে সৃজন হচ্ছে না গর্ব করার মতো সাহিত্য। অবমূল্যায়নের কারণে সাহিত্যের কেন্দ্র থেকে সরে যাচ্ছে প্রকৃত প্রতিভা। এর জায়গা দখল করছে স্বঘোষিত প্রতিভাহীন কবি লেখক নামধারিরা; ফলে বর্তমান সাহিত্য হয়ে উঠেছে নিম্নমানের। আবার যেসব লেখক মাঠে বিচরণ করছে তারা ধরে আছে পূর্ববর্তী লেখকদের ভাবধারা, তাদের সাহিত্য হচ্ছে বিখ্যাতদের অনুসরণে রচিত। মধ্যযুগীয় ভাবধারা ধরে রাখার কারণে বৈচিত্র্যতা আসছে না সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে। মধ্যযুগীয় উপস্থাপন ভঙ্গিমা বর্তমান সময়ের সাথে খাপখাওয়াতে না পারার কারণে গণমানুষে সৃষ্টি হচ্ছে সাহিত্যে বিমুখিতা। কবিতায় মধ্যযুগীয় ছন্দরীতি, অতিরিক্ত নজরুল রবীন্দ্র ও গত হওয়া লেখকদের অনুকরণের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন ছন্দরীতি, নতুন ভাবধারার সাহিত্য। ফলে পাঠক এখনো মত্ত হয়ে আছে নজরুল রবীন্দ্র ও পূর্ববর্তী বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে। এর ফলে বর্তমান নতুন সাহিত্য হয়ে উঠেছে পাঠকশূন্য। কবিতা, গল্প, উপন্যাসে বিষয়বস্তু বৈচিত্র্যতা না থাকা, নতুন ভঙ্গিমায় উপস্থাপন কৌশলের ব্যর্থতা, মধ্যযুগীয় ভাবধারা, মাত্রাতিরিক্ত অনুকরণ ও অনুসরণ ইত্যাদির কারণে বর্তমান সাহিত্য প্রশ্নবিদ্ধ। মূলত এসব কারণেই বর্তমান সাহিত্যকে পাঠক শূন্য করেছে। এখনো সাহিত্যের যথেষ্ট পাঠক রয়েছে কিন্তু এসব কারণে তারাও পড়ে আছে পূর্ববর্তী সাহিত্যে। বলা হয় বর্তমান বাংলা সাহিত্যে কাকের মতো কবি; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এদের বেশির ভাগই পূর্ববতী ভাব ধারাকে আঁকড়ে রয়েছে। বিষয়বস্তুও আগেরগুলোই ছন্দ ও উপস্থাপন রীতিও পুরনো। ফলে বর্তমান সাহিত্য আকর্ষণ করতে পারছে না পাঠককে। ক্রমাগত অবমূল্যায়নের ফলে প্রভিবাধর লেখকদের স্থান দখল করে থাকা অযোগ্যরা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে নতুন ইতিহাস। তারা মত্ত হয়ে আছে নারী পূজা, ব্যক্তি পূজা, নোংরামি ও অশ্লীলতা কিংবা পূর্ব ঢঙের ষড়ঋতুর গুণগানে। লেখক ও পাঠকের মধ্যে দূরত্ব কমাতে হলে, সাহিত্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ ও পাঠক সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন নতুন ইতিহাস সৃষ্টিকারী সৃজনের, একজন লেখককে জানতে হবে সময়ের প্রকৃত চাহিদা কী? এটা মৌলিক সৃষ্টির জন্য একান্ত অপরিহার্য। তার জন্য প্রয়োজন মধ্যযুগীয় ভাবধারা থেকে বেরিয়ে এসে বৈচিত্র্য বিষয়বস্তু, নতুন যুগোপযোগী উপস্থাপন রীতি, নিজস্ব ভাবধারার মৌলিক সৃষ্টি। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে হবে, অবশ্য তার জন্য প্রয়োজন প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন। সঠিক মূল্যায়নের অভাবে যোগ্যদের স্থলে অযোগ্যরা সমীহিত হয়, ফলে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি তো দূরের কথা সাহিত্যকে নিম্নমুখী করে তুলে।
এসব কারণেই মূলত সাহিত্যের প্রতি গণমানুষের ভালোবাসা কমে যাচ্ছে, এর জন্য কোনোভাবেই বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি একক দায়ী হতে পারে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বিনোদন পরিসরের হয়তো বিস্তৃত হয়েছে, তবে সুসাহিত্যের জন্ম হলে সেই বিস্তৃত বিনোদন মাঠকে সাহিত্য খুব সহজেই দখল করে নিতে পারত। কিন্তু সাহিত্যে বৈচিত্র্যতার অভাব ও সময়ের সাথে খাপ খাওয়ানোর যোগ্যতার অভাবে সংস্কৃতি ও সাহিত্যে মধ্যে তফাৎ সৃষ্টি হচ্ছে; এ কারণে সময়ের সংস্কৃতি অঙ্গনে সাহিত্যের গর্বিত বিচরণ লক্ষণীয় নয়। সংস্কৃতি বিমুখ সাহিত্যের বিচরণভূমি হয়ে পড়ছে সঙ্কীর্ণ। গণমানুষে সৃষ্টি হচ্ছে সাহিত্যে বিছিন্নতা। এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সাহিত্যের বিচরণ ভূমির বিস্তৃতি। সাহিত্যকে সংস্কৃতির প্রতিটি সেক্টরে সেক্টরে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন বৈচিত্র্য বিষয়বস্তু, নতুন উপস্থাপন রীতি, অনুকরণ-অনুসরণ মুক্ত নিজস্ব ভাবধারার মৌলিক সাহিত্য সৃজন; যোগ্যদের যথোপযুক্ত মূল্যায়ন। তা হলেই সাহিত্যে সৃষ্টি হবে নতুন ইতিহাস, মানুষ হবে সাহিত্য মুখী ও সৃজনশীল। সমাজ থেকে কমে যাবে সামাজিক অপরাধ, মাদকাসক্তি, অশ্লীলতা ও ধর্ষণের মতো নীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড। সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের উন্নয়ন হলে উন্নত হবে সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, সমাজ ও সভ্যতা। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement