০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সাহিত্যে প্রথম নোবেলজয়ী সুলি প্রুদোম

-

মানুষের মননকে নাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম অনেক। কেউ জাগিয়ে তোলে গানের সুরে। কেউ জাগান কথামালার সাহায্যে। কেউ বা কসরত করে। আর কেউ কেউ মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃজনকর্ম দিয়ে। এই সৃজনকর্মের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। এরকম সৃজনকর্ম দিয়ে মানুষের অন্তর্জগৎকে জাগিয়ে তুলে পরার্থে কাজ করার আহ্বান যিনি জানিয়েছিলেন তিনি প্রখ্যাত ফরাসি কবি ও প্রাবন্ধিক সুলি প্রুদোম। ফ্রান্সের এক বিস্ময়কর প্রতিভা সুলি। নিজেকে পুড়ে অঙ্গার করে মানবতাকে উপহার দিয়ে গেছেন হীরারূপী অমূল্য সাহিত্য সম্ভার।
১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে ফ্রান্সের প্যারিসের এক সাধারণ ব্যবসায়ীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পুরোনাম রেনে ফ্রানকোইজ আরমান্দ সুলি প্রুদোম।
তিনি প্রাথমিক জীবনে প্রকৌশলী পড়া আরম্ভ করে চোখের সমস্যার কারণে দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। দর্শন থেকেই তাঁর কাব্য জীবনের উদগীরণ। সে সময়ে তিনি নোটারি পাবলিকে কাজ করার জন্য আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেছেন। জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর ছিল ১৮৭০ সাল। একই বছর তাঁর জীবনে ঘটে যায় এক প্রলয়ঙ্করী ঘটনা। এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হন। অতঃপর চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসার জন্য জীবনের তরে হয়ে যান পঙ্গু। এ বছরই তাঁর জননী, সহোদরা এবং পিতৃতুল্য চাচা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সম্পূর্ণ একা হয়ে যান। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন।
১৮৬৫ সালে সর্বপ্রথম তাঁর কাব্যসঙ্কলন ‘স্তবক ও কবিতাগুলো প্রকাশ হয়। যেখানে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘ভগ্ন ফুলদানী’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুলি মোট চৌদ্দটি কাব্যগ্রন্থ, কয়েকটি পদ্যগ্রন্থ সম্পাদনা, গদ্যের চারটি গ্রন্থসহ আরো কিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
তিনি ফরাসি রোমান্টিক ধারার কাব্য থেকে নব্য এক ধারার দিকে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে শ্লাঘ্য হয়েছিল ফরাসি সাহিত্য। ঝুলিতে তুলেছিল সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান। গীতিময়তা এনেছিলেন কাব্যকলায়। নোবেল কমিটি সুলির কাব্যের প্রশংসা করে বলেছিল, ‘তাঁর কাব্যের বুনন বিশেষ ভঙ্গিময়, চিন্তার গভীরতা, ভাষার প্রাঞ্জলতা তাঁকে করেছে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। মন ও বুদ্ধির এক চমৎকার মেলবন্ধন পরিলক্ষিত হয় সুলির কাব্যে।’
‘এই ধরায় অধর স্পর্শ করে, কিন্তু মৃদুভাবে,
আর মিষ্টতার কোনো স্বাদই টিকে থাকে না;
আমি এমন একটি চুম্বনের স্বাপ্নিক, যা স্থাণু।’
(ইন দিস ওয়ার্ল্ড নামক কবিতা থেকে)

দার্শনিক ও দূরদর্শী মনোভাবের পোক্ত কথা বলেছেন এভাবে,
‘মহৎপ্রাণ সর্বদাই মহৎ। কেননা আমরা আমাদের জানুর ওপর ভর করে আছি। আমাদের দাঁড়াতে দাও।’
মিউজিক ফর ডায়িং বা মৃত্যুর জন্য সঙ্গীত নামক কবিতায় তাঁর কোবিদের প্রোজ্জ্বল স্বাক্ষর দেখা যায়। সেখান থেকে কয়েক ছত্র,
‘তুমি, যে আমাকে মরণ যাতনায় সাহায্য করবে,
একটি শব্দও বলবে না : তোমার সকল কথ্যকে লুট করতে দাও।
এখন আমাকে কিছু মৃদু সুরেলা পরিস্রাবণ শুনতে দাও,
আর আমি শান্তিতে মারা যাবো।’
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের নামের তালিকায় নামাঙ্কনে প্রথমই (১৯০১ সালে) অঙ্কিত নামটিই হচ্ছে সুলির। কী ভাগ্যের লিখন! তিনি পারেননি উপস্থিত থাকতে নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে। কারণ শিল্প-সাহিত্যের জন্য বিরামহীন শ্রম দিয়ে তিনি হয়ে পড়েছিলেন মারাত্মক অসুস্থ। এ ছাড়াও সমসাময়িক অনেক সম্মানজনক পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি পেয়েছিলেন।
নিজ জীবনের আরাম, আয়েশ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সবসময় উদাসীন ছিলেন সুলি। তাই স্বাস্থ্য তাঁর অনুকূলে ছিল না। ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে দিবারাত্রি কাজ করতেন তিনি। দৃঢ়চেতা মনোবলের কারণে কাব্য, গদ্য, দর্শন ইত্যাদিতে তিনি অনবদ্য অবদান রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে এসে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে ১৯০৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে প্যারিসের পেরে-ল্যাচেইজে সমাহিত করা হয়। তিনি শিল্প, কবিতা এবং সৃজনশীলতা অসম্ভব ভালোবাসতেন। তিনি চাইতেন নবীন প্রজন্ম যেন সৃজনশীলতার প্রতি আরো বেশি আগ্রহী হয়। তাই তাঁর নোবেল পুরস্কারের অর্থ নবীন কবিদের উৎসাহদানমূলক এক পুরস্কার প্রচলনের জন্য ব্যয় করে যান। তাঁর সবিশেষ নন্দিত দুটো কবিতার বাঙলায়ন নিচে।
ভগ্ন ফুলদানিটি

ফুলদানিটি যেখানে এই বেনার নিবন্ত হয়েছে
চুরমার হয়েছিল একটি ললনার পাখার মৃদু প্রবাহে।
অবশ্যই এটি একটি ঘন ঘাসের গোচারণভূমি হবে :
আমরা কোন শব্দ শুনতে পাইনি। ফাটল ধরেছে।
আমরা যখন ঘুমিয়েছিলাম তখন ক্ষুদ্র আঘাতটি ছড়িয়ে পড়েছে।
একটু একটু করে
একটি লম্বা ধীর মার্চিং সারি এগোচ্ছে
ছড়ানো মূল থেকে ভাঁজকৃত ঠোঁটে।
বারি ফোঁটায় ফোঁটায় ক্ষরিত হচ্ছে,
সারিতে ক্ষরণ হচ্ছে কিন্তু আমরা তার ক্ষোদক দেখতে পাচ্ছি না।
ফুলগুলো তাদের সব প্রাণরস বের করে দিচ্ছে।
ফুলদানিটি ভগ্ন : স্পর্শ করো না।
একজনের দ্রুত মসৃণ হাত আমরা ভালোবাসি
পাখার মৃদু তরঙ্গ দিয়ে কি আমাদের টোকা দেয়া যাবে,
আর আমরা খানখান হয়ে যাব নিশ্চিত দ্বিখণ্ডিতের ন্যায়
সেই ভগ্ন ফুলদানির ন্যায়। আর কেউই জানে না।
পৃথিবী কঠোরতা শুধু দেখল
একটি ফুলদানির বক্র উপরিভাগ একজন ললনার পাখা আবারো ঘর্ষণ করল,
তাই মৃদুভাবে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ও লহু কষ্টের সাথে ঝরছে।
ভগ্ন ফুলদানিটিকে স্পর্শ করো না।

(কবিতাটি সুলি প্রুদোমের দ্য ব্রোকেন ভেইজ কবিতার বাঙলায়ন। যেটি ফরাসি থেকে ইংরেজিতে রূপান্তর করেছেন রবার্ট আর্ক্যামবিআউ কবিতাটি পোয়েম হান্টার থেকে উৎকলিত)

কখনো তাকে দেখো না বা শুনো না

কখনো তাকে দেখো না বা শুনো না,
কখনো তার নাম উচ্চৈঃস্বরে বলো না,
কিন্তু সর্বদা বিশ্বাস নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করো
আর তাকে ভালোবাসো।

আমার বাহু উন্মুক্ত করতে আর অপেক্ষার প্রচেষ্টায়,
কিছুতে তারা উদ্বাহু হতো না,
কিন্তু উভয়ই সর্বদা উদ্বাহু এখন তাকে জড়িয়ে নিতে
তাকে প্রেম করতে।

শুধু তাকে জড়িয়ে রাখতে উভয় বাহুই অক্ষম হলে,
লোনাজল ব্যয়িত হয় পরিমাণহীন,
এই নুনজল সদাই ঝরে,
তাকে অনুক্ষণ ভালোবাসতে।

কখনো তাকে দেখো না বা শুনো না,
কখনো তার নাম উচ্চৈঃস্বরে বলো না,
কিন্তু এমন প্রেম যা চিরদিন অধিক সুকুমার
সর্বদা তাকে ভালোবাসতে। সর্বদা! হ

(কবিতাটি সুলির ইংলিশে রূপান্তরিত কবিতা নেভার টু সি অর হেয়ার হার নামক কবিতার বাঙলায়ন।
কবিতাটি অল পোয়েট্রি ডটকম থেকে সংগৃহীত)


আরো সংবাদ



premium cement