২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সংযমের শিক্ষা বাঁচাতে পারে গিবতের শাস্তি থেকে

-

সমাজের সব জায়গায় বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য যে বিষয়টি খুব বেশি চোখে পড়ে তা হলো পরচর্চা বা গিবত। দু’জন বা তার বেশি মানুষ একত্রিত হলেই তাদের মধ্যে কথা হয় তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে। যদিও এই পরচর্চা বা গিবতের জন্য নারীদেরই বেশি দেখা যায় তবে পুরুষও এ থেকে পিছিয়ে নেই। নারীরা যেমন সাংসারিক কাজের অবসরে একটু সময় পেলেই গল্পগুজবের ছলে মেতে ওঠে পরচর্চায় তেমনি পুরুষও। পরচর্চা বা গিবতের কারণে অনেক সময় সংসারে অশান্তি থাকে, সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, মারামারি খুনোখুনির ঘটনাও ঘটে। অথচ এই গিবতের বিষয়ে কঠিনভাবে সতর্ক করা হয়েছে পবিত্র কুরআনে। গিবত সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরশাদ করেছেন- ‘তোমরা একে অন্যের গিবত করো না। তোমাদের কেউ তোমাদের মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে কি পছন্দ করো? নিশ্চয়ই তোমরা তা পছন্দ করো না এবং আল্লাহকে ভয় করো, অবশ্যই আল্লাহ তওবা কবুলকারী ক্ষমাশীল।’ (সূরা হুজরাত, আয়াত-১২) নিজের মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার মতো এত বড় গোনাহ গিবত অথচ গিবতকে মানুষ খুব সহজভাবেই নেয়। অনেকেই এর জন্য যুক্তিও দেন এবং বলেন, সত্য কথা বললে সমস্যা কি? অনেকেই এই সত্য বলার জন্য নিজেকে সাহসী মানুষ ভাবেন, নিজেকে নিজেই সাহসী ও চালাকের তকমা দেন। আর এই গিবত শুধু মুখের কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং হাত-পা নেড়ে, চোখে ইশারা করেও গিবত করা যায়। যেমন কোনো প্রতিবন্ধী বা পঙ্গু লোককে ব্যঙ্গ করে কথা বলা, বা তার এই পঙ্গুত্ব দোষটি প্রকাশ করার জন্য পঙ্গুর মতো চলা, বা কোনো বামন বা ত্রুটিপূর্ণ মানুষ নিয়ে ইশারা ইঙ্গিত করাও গিবত। অর্থাৎ কারো অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কথা বলা যা শুনলে সে মনে কষ্ট পাবে বা লজ্জা পাবে তাই গিবত। এ বিষয়ে ইমাম গাজালি রহ: এক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘অবজ্ঞা, অবহেলা, বেশি কথন, ইঙ্গিত, ইশারা, লেখনী এবং হাসি-তামাশার মাধ্যমে অন্যের দোষ বয়ান করা যায়। এমন কি একজন লোকের বংশ, চরিত্র, চেহারা, পোশাক, মোট কথা- প্রত্যেক বস্তুরই দোষ বের করা যায়।’ এই বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, কোনো ব্যক্তির যেকোনো বিষয়ে দোষ ধরা, তা অন্যের কাছে বলে বেড়ানো, বা তা নিয়ে অপমানজনক কথা বলা- সবই গিবত। যা সচরাচর মানুষ করে বেড়ায়। এর কথা ওর কাছে, ওর কথা তার কাছে। এ কারণে মহান আল্লাহপাক দৃঢ়তার সাথে এগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন এবং এসব কাজকে মৃত ভ্রাতার গোশত ভক্ষণের সাথে তুলনা করেছেন।’ হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- ‘রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা কি জানো গিবত কাকে বলে?’ সাহাবিরা বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: ভালো জানেন।’ তিনি বলেন, ‘তোমার কোনো ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গিবত।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমি যে দোষের কথা বলি, সেটি যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহলেও কি গিবত হবে?’ উত্তরে রাসূল সা: বলেন, ‘তুমি যে দোষের কথা বলো, তা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তবে তুমি অবশ্যই গিবত করলে আর তুমি যা বলছ, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তবে তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলে।’ (মুসলিম) আমরা অনেকেই এই গিবত আর অপবাদের মধ্যে পার্থক্যটি বুঝতে পারি না। গিবত এবং অপবাদ দুটোই কবিরা গুনাহ এবং এর শাস্তি বড়ই কঠিন।
যেসব গোনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না তার মধ্যে হচ্ছে এই গিবত আর অপবাদ। ব্যভিচার থেকেও মারাত্মক ও নিকৃষ্টতম পাপ ও কবিরা গোনাহ হলো এই গিবত। অন্যান্য পাপ তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন কিন্তু গিবতকারীর গোনাহ শুধু তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না যার গিবত করা হয়েছে সে ব্যক্তি যদি ক্ষমা করে, তবেই আল্লাহর কাছে তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন। গিবত বা পরচর্চা, পরনিন্দা ইসলামী শরিয়তে সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এমনকি গিবত করা যেমন পাপ, গিবত শোনাও তেমনি সমান পাপ। গিবত খুবই মারাত্মক গোনাহ এবং এর পরিণাম ভয়াবহ এটি যারা না জানে তারাও যেমন এটিতে লিপ্ত আবার অনেক জানা মানুষও এর ভয়াবহতা ভুলে গিয়ে এই গিবতের মতো পাপকাজে জড়িয়ে যাচ্ছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
এ জন্য গিবতের বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। কেউ যদি আপনার সাথে অন্যের গিবত করে, তখন তাকে থামিয়ে দেবেন এবং আল্লাহর হুকুমের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। গিবতের গোনাহর বিষয়ে সাবধান করে দেবেন। আর সে যদি আপনার কথা না শোনে তাহলে আপনি সেখান থেকে সরে আসুন। হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন আমাকে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আমাকে তামার নখবিশিষ্ট একদল লোকের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তারা তাদের নখগুলো দিয়ে স্বীয় মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল! এরা কারা? জিবরাইল আ: বললেন, এরা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত এবং তাদের মানসম্মান নষ্ট করত। অর্থাৎ তারা মানুষের গিবত বা পরচর্চা করত।’ (আবু দাউদ)
তাই সব মুসলমানের উচিত, গিবত বা পরচর্চার মতো কবিরা গোনাহ থেকে নিজেদের বাঁচানো এবং মহান রবের কাছে তাওবা করা। আর এই শিক্ষাটি নেয়া হয় রমজান মাসের সংযমের শিক্ষা থেকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা না বলা। সিয়াম সাধনা শুধু না খেয়ে থাকাই নয়; বরং সব ধরনের অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখা, এমনকি কম কথা বলা। বেশি কথা বললেই অন্যের সম্পর্কে কথা চলে আসে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে সবাইকে। একান্তই যদি প্রয়োজন মনে হয় তাহলে কারো বিষয়ে অন্যের সাথে আলোচনা না করে ওই ব্যক্তিকে চুপিচুপি সাবধান করতে হবে বা তার ভুলগুলো তাকে বলে শুধরানোর চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু অন্যের কাছে তার অবর্তমানে বা অন্যের সামনে কাউকে লজ্জা দেয়া যাবে না। এ ধরনের কাজ ইসলামের শরিয়তে নিষিদ্ধ, হারাম। এটি মনে রাখতে হবে।
লেখিকা : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement