২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আলেমদের দায়িত্ব

-

(শেষাংশ )
এ যুগে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সা: কেন বহু বিবাহ করেছিলেন? একটি-দু’টি নয়! একজন মানুষের জন্য এত স্ত্রীর কী প্রয়োজন হতে পারে? তার মধ্যে কি লোলুপতা ছিল? আয়েশের প্রবণতা ছিল? নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক। আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের চিন্তা ও বক্তব্য থেকে আমাদের হিফাজত করুন।
মানুষের মধ্যে এ ধরনের প্রশ্ন দিন দিন বেড়ে চলছে। এর ফলে মুসলমানদের অন্তর থেকে রাসূলুল্লাহর ভালোবাসা মুছে যাচ্ছে। যদি রাসূলের ভালোবাসা অবশিষ্ট না থাকে, তাহলে ইসলাম অবশিষ্ট থাকবে না। কেননা, দ্বীন ইসলামের ভিত্তি রাসূলের নিষ্কলুষ নবীসত্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দায়িত্ব হলো- এই প্রশ্নের সুন্দর যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান বের করা। এমনভাবে তা উপস্থাপন করা, যাতে সংশয়বাদীদের মস্তিষ্ক তা গ্রহণ করে।
রাসূলুল্লাহর ওপর আরেকটি আপত্তি প্রবলভাবে উত্থাপিত হয়- কেন তিনি বনু কোরাইজা গোত্রের সব পুরুষকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন? কয়েক বছর আগে আমি আমেরিকা গিয়েছিলাম। কয়েকজন মুসলমান দ্বায়ী যুবক আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। তারা জানায়, আমরা যখন দাওয়াতের কাজ করি, তখন খ্রিষ্টান ও ইহুদিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের বলে, তোমাদের নবী তো অত্যন্ত জালেম ছিল। বনু কোরাইজা গোত্রের সব পুরুষকে হত্যা করেছে। শুধু মহিলারাই নিষ্কৃতি পেয়েছে। এটি কী ধরনের রহমত? অথচ তোমরা বলো- তোমাদের নবী পুরো পৃথিবীর জন্য রহমত। তোমরা বলো- ইসলাম শান্তির ধর্ম।
এই প্রশ্ন অমুসলিমরা আমাদের যুবক দ্বাঈদের প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে। অথচ আমরা, ওলামায়ে কেরাম নিশ্চিন্ত মনে মাদরাসার ভেতরে কুরআন-হাদিস শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। আমরা অনুমানও করতে পারব না, কী বিপুল মানুষ ইউরোপে, আমেরিকায়, পাকিস্তানে, ভারতে এমনকি বাংলাদেশে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, নাস্তিকতা বা ধর্মহীনতা-বিষয়ক বইপত্র সব থেকে বেশি পঠিত হয় স্বয়ং সৌদি আরবে! আমেরিকায় নয়! ইউরোপে নয়! আফ্রিকায় নয়! খোদ সৌদি আরবে! কল্পনা করতে পারছেন? আমরা অনুমান করতেও ব্যর্থ হচ্ছি, মানুষ আলেমদের আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
একটি আপত্তি ইউরোপে ব্যাপকভাবে তোলা হয়, ইসলাম মুসলিম নারীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে রেখেছে। ১৯৯৪ সালে আমি যখন ইউরোপে যাই, অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, মুসলিম নারীরা শিক্ষায় সব থেকে পিছিয়ে কেন? এর দায় কি ইসলামের ওপর বর্তায় না? ইসলাম কি নারী শিক্ষার বিরোধী? এ ধরনের অনেক আপত্তি ও অভিযোগ ইসলাম সম্পর্কে উত্থাপন করা হয়। অথচ নারী নিপীড়ন ও নারীকে পশ্চাৎপদ করে রাখার পেছনে মূল দায় পাশ্চাত্য দর্শনের; কিন্তু অপবাদ দেয়া হচ্ছে ইসলামের ওপর। ইউরোপীয় দর্শনের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলার কথা ছিল।
ইউরোপের দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসে শিক্ষিত নারীদের ইতিহাস জানা যায় না। নারীশিক্ষার ধারা ইউরোপে কখনো ছিল না। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইউনিভার্সিটি। যার বয়স প্রায় ৮০০ বছর। অথচ বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত এখানে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ছিল না। আইন করে নারীদের ভর্তি নিষিদ্ধ রাখা হয়েছিল। ’২০ শতকের শুরুতে নারীরা এখানে পড়াশোনার সুযোগ পায়।
ইসলাম নারীদের সম্পদের অধিকার দিয়েছে প্রায় ১৫ শ’ বছর আগে। অথচ ব্রিটিশ আইনে ১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত সম্পত্তিতে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। এমনকি আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত ছিল যে, বিয়ের পর নারীদের নিজের ওপর নিজের কোনো অধিকার থাকবে না। ব্রিটেনের সাধারণ আইনে এটি লিপিবদ্ধ না থাকলেও ব্রিটিশ সমাজে এটি প্রচলিত, কেউ জুয়ায় হেরে গিয়ে তার স্ত্রীকে পর্যন্ত বাজি রাখতে পারত। এটি ব্রিটেনের সাধারণ প্রচলনে পরিণত ছিল। নারীদের মধ্যে রুহ বা আত্মা আছে কি নেই- এ নিয়ে ইউরোপে কিছু দিন আগ পর্যন্ত বিতর্ক চলমান ছিল। এ হলো আধুনিক উন্নত ইউরোপের অবস্থা।
ইসলামের বিরুদ্ধে উত্থাপিত আপত্তির জবাব দিতে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, মুসলিম ইতিহাসের শিক্ষায় অগ্রবর্তী নারীদের জীবনী সঙ্কলন করব। কারণ শিক্ষায় অগ্রসর নারীদের জীবনী সামনে আনার মাধ্যমে এ প্রশ্নের কার্যকর জবাব দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালার শোকর, কোনো প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা ছাড়াই আমি একা এ কাজ ঘরে বসে শুরু করি। দিনভর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিউটি শেষে সন্ধ্যায় ঘরে এসে পড়াশোনা করতাম। পাশাপাশি লেখার কাজ চালিয়ে যেতাম। গবেষণার স্বার্থে আমাকে নতুন নতুন কিতাব কিনতে হতো এবং সেটি অবশ্যই নিজের টাকায়। অনেকে হয়তো অনুমান করত, ইংরেজ সরকার এ প্রকল্পের জন্য আমাকে অর্থায়ন করে। কিন্তু এই প্রকল্পের জন্য কেউ আমাকে ৫০ পয়সাও দেয়নি। আল্লাহর মেহেরবানিতে আমি কাজ করে যেতে থাকলাম। নারী মুহাদ্দিসদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল। এক পর্যায়ে সেটি ৯ হাজার অতিক্রম করে গেল। খণ্ড সংখ্যা চল্লিশের ওপরে গিয়ে দাঁড়াল। এখানেই সমাপ্ত করা আমার ইচ্ছা ছিল না; কিন্তু বহু মুসলিম স্কলার আমাকে পরামর্শ দিলেন, আপাতত গবেষণা স্থগিত করুন। নয়তো এটি কখনোই শেষ হবে না।
আমাদের এক প্রাচ্যবিদ বন্ধু আছেন। জাতীয়তায় ইংরেজ। আমেরিকায় থাকেন। একটি বইয়ে তিনি লিখেন, মুসলমানরা বলে, তাদের ধর্মে নারী শিক্ষার ব্যাপারে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তারা যদি পাঁচজন শিক্ষিত মুসলিম নারীর নাম বলতে পারে, আমরা তাদের দাবি মেনে নেবো।
আমার এ গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি আমাকে বলেন, আমি মাত্র পাঁচজনের কথা জানতে চেয়েছিলাম। আপনি তো পাঁচ হাজারেরও দ্বিগুণ নারীর নাম সংগ্রহ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আর কখনো কেউ প্রশ্ন তুলতে সাহস করবে না। আলহামদুলিল্লাহ। বাস্তবতা তাই হয়েছে। অক্সফোর্ডসহ ইউরোপের সব জায়গায় সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement