২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বৃক্ষরোপণ ইবাদত

-

বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু, মানুষ ও পরিবেশের আল্লাহর পক্ষ থেকে অমূল্য নিয়ামত। খাদ্য, বস্ত্র, পুষ্টি, বাসস্থান, ওষুধপত্র, অর্থেও জোগানদাতা হিসেবে বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষা ও উন্নয়নে বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাণিজগতের অস্তিত্ব উদ্ভিদ জগতের ওপর নিভর্রশীল এবং এ যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীকে বাসযোগ্য অবস্থানে গড়ে তোলা বা কোনো দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অবশ্যই ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক। কিন্তু আমাদের রয়েছে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন মাত্র ১০ শতাংশ বনভূমি এবং ৭ শতাংশ গ্রামেগঞ্জে রোপিত বা সৃজিত বনভূমি।
যে দেশে বনভূমি যত বেশি সে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের বনভূমি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। এ থেকে বোঝা যায় বৃক্ষরোপণ আমাদের জন্য অতীব জরুরি। বৃক্ষ পরম বন্ধু হয়ে গ্রিন হাউজের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে, প্রয়োজনীয় খাদ্যেও জোগান দেয়, অক্সিজেন সরবরাহ করে, বাতাসের অতিরিক্ত কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণের মাধ্যমে পরিবেশ নির্মল রাখে, ক্ষতিকর দূষিত বাতাস শোধন করে জীবজগৎকে রক্ষা করে, সুশীতল ছায়া দেয়, মাটির ক্ষয় রোধ করে, মাটিতে জৈবপদার্থ যোগ করে মাটির উর্বরতা রক্ষা করে, মাটিতে উপযুক্ত পরিমাণ পানি ধরে রাখে, জ্বালানি সরবরাহ করে, জীবন রক্ষাকারী মূল্যবান ওষুধের কাঁচামালের জোগান দেয়, পশু-পাখি ও অন্যান্য বণ্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়-ঝঞ্ঝা জলোচ্ছ্বাস বন্যা রোধ করে। বৃক্ষের দ্বারা বায়ু দূষণকারী পদার্থ যেমন- কার্বন-মনোক্সাইড, সালফার-ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং গাছের পাতা ঝড়-বাতাসের গতিকে রোধ করে, বৃষ্টির সৃষ্টি করে ও মরুময়তা রোধ করে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতিকে মায়াময় ও সৌন্দর্যময়রূপে সাজিয়ে তোলে।
বৃক্ষরোপণ অন্যতম একটি ইবাদত। ইসলামের দৃষ্টিতে এ কাজ অত্যন্ত পুণ্যময়। রাসূল সা: স্বয়ং বৃক্ষরোপণ করেছেন এবং বৃক্ষরোপণ করার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন। বৃক্ষরাজি সবুজ শ্যামল পাতা বিস্তার করে পরিবেশকে সুন্দর রাখে, আবহাওয়াকে স্বাস্থ্যকর করে তোলে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য অনুকূলে রাখে যা মহান মালিকের অপার করুণার পরিচায়ক। ছোট্ট বীজটি থেকে নির্দিষ্ট সময়ে চারা অঙ্কুরোদগমিত হয়ে অত্যন্ত কোমল পাতা গজাতে থাকে এবং ধীরে ধীরে গাঢ় সবুজে তা ছেয়ে দেয় চারপাশকে। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘কোনো মুসলিম যদি একটি চারাগাছ রোপণ করে কিংবা বীজ বপন করে, তারপর সেই গাছ ও ফসল দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় কিংবা পশুপাখি খায়, তাহলে এর বিনিময়ে তার আমলনামায় সাদকাহ প্রদানের সাওয়াব লেখা হয়’ (মিশকাত)।
হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, সতেজ পাতা আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভের অন্যতম উপলক্ষ হয়। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত আখিরাতের মঙ্গল কামনার জন্য সুবিধাজনক স্থানে বৃক্ষরোপণ করা। শূন্যস্থানগুলোকে সবুজ উদ্যানে পরিণত করা। যদ্বারা মৃত ব্যক্তিরাও উপকৃত হন।
পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখা ও এর অনুকূলে পরিশ্রম করার শিক্ষাও ইসলাম দিয়েছে। কেননা, পর্যাপ্ত পরিমাণ বনভূমি ও বৃক্ষ না থাকার কারণে আমাদের প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তার মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, মরুময়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাতাসে কাবর্ন-ডাই-অক্সাইড বাড়ছে। জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর ক্লোরোফ্লোরো কার্বন, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ অনেক অনেকগুণ বেড়ে যাচ্ছে, বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তরে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে- ফলে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসছে। এসিড-বৃষ্টি ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে মরু অঞ্চল ও এন্টার্কটিকা মহাদেশের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী দুই দশকের মধ্যে সারা বিশ্বের ৬০০ মিলিয়ন মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে গবেষক ও বিশ্লেষকদের ধারণা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বর্তমানে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৪০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। এসব জটিল প্রাকৃতিক সমস্যাকে সফলভাবে মোকাবেলার জন্য এখনই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবারই ইসলামের শিক্ষা মেনে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে পরিবেশকে সুন্দর ও মুক্ত রাখার জন্যও বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই।
বৃক্ষনিধন অন্যতম একটি অপরাধ। কেননা এটিও একপ্রকার অপচয়। এ কাজ থেকে আমাদেরকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও উত্তপ্ত জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামগ্রিক জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। পশু-পাখির প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষি উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ২২ শতাংশ কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত সব কিছুকেই আল্লাহ তায়ালা বিশেষ প্রয়োজনে সৃষ্টি করছেন। অপ্রয়োজনে এবং লোভের কারণে কখনোই এগুলোকে নষ্ট করা উচিত নয়। এতে শরিয়তের দৃষ্টিতে যেমনভাবে পাপী হতে হয়, তেমনিভাবে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতির জন্যও দায়ী হতে হয়, যা মানবতার পরিপন্থী এবং যেকোনো ধর্মের বিচারেও অন্যায়। পক্ষান্তরে পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষরোপণ যেমন উপকারী, মানবসমাজেও তা সম্মানজনক ও সেবামূলক হিসেবে বিবেচিত। আবার আল্লাহর অনন্ত সন্তুষ্টি লাভেরও অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। মহান মালিক আমাদের সবাইকে এ গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি অনুধাবনের শক্তি দিন যাতে আমরাও তাঁর প্রিয় হতে পারি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও মুদ্রণ ব্যবস্থাপক

 

 


আরো সংবাদ



premium cement