২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মুমিনের ঈদ

উম্মেহানি বিনতে আব্দুর রহমান - ছবি : সংগৃহীত

হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন শুদ্ধ সংস্কৃতির নির্মাতা এবং পরিচ্ছন্নতা ও মানসিক ঔজ্জ্বল্যে তিনি ছিলেন এক মহিমান্বিত মানুষ। তাঁর প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা,ঔদার্য,বিবেচনাবোধ তাঁর সময় ও পরিবেশ থেকে তাঁকে স্বাতন্ত্র দিয়েছে। অথচ তাঁর সমাজ ও সময়, তাঁর যুগ ও পরিবেশ ছিল পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত।

হযরত আনাস(রা. বলেন, মদিনায় নবী সা: হিজরত করে আসার পর দেখলেন, মদীনাবাসী দু’দিন খুব আনন্দ উৎসব করছে, তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, এ দুদিনে তোমরা কী কর? তারা বললেন, আমরা জাহিলিয়্যাতের যুগে এ দুটো দিন খেলাধুলা, আমোদ ফুর্তি করতাম। নবী সা: বললেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের এ দুটি দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি দিন প্রদান করেছেন। তার একটি হলো ঈদুল আযহার দিন ও অপরটি হলো ঈদুল ফিতরের দিন (সুনানু আবু দাউদ: ১১৩৬)।

আরবি ঈদ শব্দটি ‘আওদ’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত এর আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা৷ ইবনে জারির রা. দ্বিতীয় হিজরিতে সংঘটিত ঘটনাবলির মাঝে ঈদের নামাজের কথা উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন- নবী করীম সা: এ বছরই মানুষদেরকে নিয়ে ঈদগাহে গমন করেন এবং ঈদের নামাজ আদায় করেন আর এটিই ছিলো ইসলামে প্রথম ঈদের নামাজ। আর এভাবেই মুসলিম উম্মাহ পরিপূর্ণ নেয়ামত কামেল শরীয়ত নিয়ে স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তোমার নিকট যে হক এসেছে তা বাদ দিয়ে তুমি তাদের অনুসরণ করো না, কেননা আমি তোমাদের সকলকে শরীয়ত ও বিধান দান করেছি”। (সূরা মায়েদা : ৪৮)।

মুসলিম বিশ্বে ঈদ আসে আনন্দের ভিন্ন সংজ্ঞা নিয়ে, সারা বিশ্বে যখন ‘ভোগেই প্রকৃত সুখ’ তত্ত্বের চর্চা হচ্ছে ঠিক তখনি মুসলিমরা ‘ত্যাগেই প্রকৃত সুখ’ এর দীক্ষা নিচ্ছে। রবের প্রিয়দের জন্য এ শিক্ষা সাময়িক নয় বরং মুসলিমদের পুরো জীবন হবে রমাদানের আদর্শকে ধারণ করে। এক মাস রমাদানের পর ঈদুল ফিতর আসে সিয়াম পালনকারীদের জন্য ক্ষমার বার্তা নিয়ে, ত্যাগের সাথে আনন্দের সমন্বয়ে মু'মিন বান্দার জন্য ঈদ একটি আনন্দোপহার।

মু'মিনের ঈদের রাত এবং দিন: বস্তুবাদীদের জীবন দর্শন হলো দুনিয়ার সুখ শান্তি লাভ করা, আর মুসলিমদের জীবন দর্শন হলো ক্ষণস্থায়ী জীবনের পরিবর্তে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে আখেরাতের স্থায়ী জীবনকে সুন্দর করা। ঈদ মূলত এক মাস রোজা পালনকারীদের জন্য দুনিয়ায় পুরষ্কারের সামান্য নমুনা, মু'মিনের ঈদের রাত এবং দিন হতে হবে হাবিবে রাসূল সা: এবং সাহাবায়ে কেরামের পূর্ণ অনুসরণে। রহমতের এ মাসে রবের ক্ষমা প্রাপ্তরা রবের সাক্ষাতে কতো বেশি আনন্দিত হবে তা মানুষের কল্পনা সীমার বাইরে। ঈদের রাতে কৃত দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি জুমার রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, অর্ধ শাবানের রাত এবং দুই ঈদের রাতসহ এ পাঁচ রাতে কোনো দোয়া করে; সে রাতে তার কোনো আবেদনই ফিরিয়ে দেয়া হয় না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৯২৭)।

মূলত ঈদুল ফিতরের শিক্ষা হলো ত্যাগেই প্রকৃত আনন্দ নিহিত। ঈদের রাতের আমল মহান রাব্বুল আলামীনের অনেক বেশি পছন্দনীয়। হাদীসে আছে, রমজানে ইফতারের সময় প্রতিদিন আল্লাহ এক হাজার জাহান্নামবাসীকে (যাদের প্রত্যেকের জন্য জাহান্নাম অবধারিত ছিলো) জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন। তবে, রমাদানের শেষ দিন (ঈদের রাত) রব্বে কারীম রমাদানের প্রথম থেকে ঐ দিন পর্যন্ত যতো মানুষকে ক্ষমা করেছেন তার সমান পাপীকে ক্ষমা করে দেন।(বায়হাকী)।

ঈদের দিন রাসূলুল্লাহ সা: ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন, ভালো কাপড় পড়তেন, আতর মাখতেন। সুতরাং সামর্থনুযায়ী ভালো পোশাক পড়া সজ্জিত হওয়া সুন্নাত। ঈদ উপলক্ষে সাধ্যমত ভালো খাবার খাওয়া এবং গরীবদের ভালো খাবার খাওয়ানো সুন্নাত৷

রাসূল সা: এবং সাহাবায়ে কেরাম ঈদ গাহে যেতেন এক পথে এবং ফিরতেন অন্য পথে, আসা যাওয়ার পথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন এই বলে ‘তাকব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ ৷ সবশেষে ভুলত্রুটির জন্য মাফ চাওয়া এবং আমলসমূহের কবুলিয়াতের জন্য দুআ করা মু'মিনের ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য। রাসুল (স.) বলেন, ঈদুল ফিতরের দিন সকালে সকল ফিরিশতা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, হে মুসলিমগণ! তোমরা দয়ালু প্রতিপালকের দিকে এগিয়ে আস, উত্তম প্রতিদান ও বিশাল সাওয়াব প্রাপ্তির জন্য এগিয়ে আস। তোমাদের রাত্রিবেলার নামাযের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশ মেনে নামায পড়েছ, তোমাদেরকে দিনগুলোতে রোজা রাখতে বলা হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশও পালন করেছ, এক মাস রোজা রেখেছ। গরীব দুঃখীরদের পানাহারের মাধ্যমে নিজ প্রতিপালককে তোমরা পানাহার করিয়েছ, এখন নামায পড়ার মাধ্যমে সেগুলোর প্রতিদান ও পুরস্কার গ্রহণ কর। ঈদের নামায পড়ার পর ফিরিশতাদের মাঝে একজন ঘোষণা দেন, শোন, নামায আদায়কারীরা! তোমাদেরকে মহান রাব্বুল আলামীন মাফ করে দিয়েছেন, সকল গুনাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাও। আর শোন! এ দিনটি হচ্ছে পুরস্কার প্রদানের দিন,আকাশে এ দিনের নামকরণ করা হয়েছে ‘পুরস্কারের দিন’ (আল মুজামুল কাবীর লিত তাবারানী, হাদীস নম্বর-৬১৭ ও ৬১৮)।

নবী জীবনের প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মুহূর্তই যেন ছিল তাদের জন্য ঈদের দিন, যারা তাঁর সাথে উঠাবসা ও চলাফেরা করতেন, এবং তাঁর শরীয়তের আলোকরশ্মি দ্বারা আলোকিত হতেন তাদের জন্য। সাহাবীরা ছিলেন রাসুল স: এর আনুগত্যের মূর্ত প্রতীক, রাসূল সা: যখন যে কাজটি যেভাবে করছেন বা যেভাবে করতে নির্দেশ দিয়েছেন সাহাবীরা সে কাজটি সেভাবেই পালন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এ কারণে অনেক সাহাবীকেই জীবদ্দশাতেই বেহেশতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। তারপরও তারা সারা মাস রোজা রেখে নিজেদের আমলের প্রতি ভরসা না করে আল্লাহতায়ালার ভয়ে ঈদের দিন কান্নাকাটি করতেন। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবীদের যদি এই হয় চেতনা, তবে আমাদের চেতনা কেমন হওয়া উচিত তা ভেবে দেখা দরকার। আমাদের কর্তব্য হলো, রোজার শিক্ষাকে কাজে লাগানো এবং অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বিবর্জিত শুদ্ধ সংস্কতির সফেদ আনন্দ উৎসব পালন করা।

রব্বে কারীম আমাদেরকে ক্ষমা করুন, অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করুন এবং দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানে পুরস্কার প্রাপ্তদের সাথে শামিল করুন, আমীন!

 


আরো সংবাদ



premium cement