২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আত্মশুদ্ধির মাসে নিজেকে পরিশুদ্ধ করি!

-

রমজান আত্মশুদ্ধির মাস, আত্মসংযমের মাস। পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনের মাধ্যমে আমাদের মধ্যকার পারস্পরিক হিংসা, নিন্দা ও অশ্লীলতাকে পুড়িয়ে দেয়া হয়, তাই এ মাসকে রমজান বলা হয়।
রোজার আরবি শব্দ হলো ‘সাওম’। সাওমের আভিধানিক অর্থ হলো- বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় ‘সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ থেকে বিরত থাকাকে সাওম তথা রোজা বলে।
হজরত আদম আ: থেকে নিয়ে হজরত ঈসা আ: পর্যন্ত সব নবী রাসূলের ওপর রোজা ফরজ ছিল। হজরত আদম আ: প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতেন। হজরত মূসা আ: তো জিলকদ ও জিলহজ মাসের ১০ দিন রোজা রাখার পর তাওরাত কিতাব পেয়েছিলেন। হজরত নূহ আ: প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোজা রাখতেন। হজরত ইয়াহিয়া আ: এবং হজরত ঈসা আ:ও রোজা রেখেছেন। কিন্তু সে সময়ের রোজা আর আমাদের মুসলিমদের রোজার মধ্যে পার্থক্য আছে।
তখনকার রোজার সময়সীমা, সংখ্যা, কখন তা রাখা হবে নির্ধারিত ছিল না এবং ধারাবাহিকভাবে এক মাস রোজা রাখার প্রচলন ছিল না। পরবর্তীতে আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা:-এর ওপর ৬২৪ সালে দ্বিতীয় হিজরিতে পরিপূর্ণ এক মাস রোজা রাখার বিধান নাজিল হয়।
আল্লাহ কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে; যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৩)।
এ রমজানে সিয়াম পালনের তাগিদ দিয়ে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের হিদায়াতের জন্য এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাস পায় সে যেন রোজা পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান এবং কঠিন করতে চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করো এবং তিনি তোমাদের যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত- ১৮৫)।
যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোজা পালন করবে, আল্লাহ তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে’ (বুখারি-১৯০১)।
হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাসে আমার উম্মতের জন্য পাঁচটি বস্তু দান করা হয়েছে; যা আগের উম্মতদের দেয়া হয়নি- ১. রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও পছন্দনীয়; ২. ইফতার পর্যন্ত ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন; ৩. আল্লাহ প্রতিদিন জান্নাতকে রোজাদারদের জন্য সজ্জিত করেন এবং বলেন, অচিরেই আমার সৎ বান্দারা ক্লেশ-যাতনা দূরে নিক্ষেপ করে আমার দিকে ফিরে আসবে; ৪. রমজানে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়। যাতে তারা এসব পাপ কাজ করাতে না পারে যা অন্য মাসে করানো সম্ভব; ৫. রমজানে রোজাদারকে শেষ রাতে মাফ করে দেয়া হয়’ (মুসনাদ আহমাদ- ৭৯০৪)।
রোজার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘আস-সাওমু জুন্নাতুন’ অর্থাৎ- রোজা ঢালস্বরূপ (সুনান ইবনে মাজাহ-১৬৩৯)। রোজাকে ঢাল বলার কারণ হচ্ছে- যুদ্ধে ঢাল যেমন তলোয়ার, তীর ও বল্লম থেকে যোদ্ধাকে হিফাজত করে; তেমনি রোজাও রোজাদারকে গুনাহের কাজ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে। আর রাসূলুল্লাহ সা: সাওমের গুরুত্বে আরো বলেছেন, ‘আল্লাহ নিজ হাতেই এর প্রতিদান দেবেন’। হাদিসে এসেছে- হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি ভালো আমল ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।’ মহান আল্লাহ বলেন, ‘তবে রোজা ব্যতীত। কেননা তা আমার জন্য, আমি নিজ হাতেই এর প্রতিদান দেবো। সে তো তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যই বর্জন করেছে’ ( মুসলিম- ২৭০৭)।
রোজাদারকে আল্লাহ বিশাল সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, হজরত সাহ রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘জান্নাতে এমন একটি দরজা আছে যার নাম হলো রাইয়ান। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল রোজাদার ব্যক্তিরাই প্রবেশ করতে পারবে, অন্যরা কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে- রোজাদারগণ কোথায়? তারা ছাড়া কেউ এতে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর যখন রোজাদাররা সেখানে প্রবেশ করবে, তখন তার দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে কেউ এতে প্রবেশ করতে না পারে’ (বুখারি-১৮৯৬)।
আমাদের কাছে রমজান মাস এসেছে। এ মাসে যদি আমরা আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ করাতে না পারি তাহলে আমাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর কে হতে পারে?
হাদিসের মধ্যে এসেছে, একবার রাসূলুল্লাহ সা: সাহাবিদের বললেন, ‘তোমরা মিম্বরের কাছে এসো। তখন সাহাবিরা মিম্বরের কাছে এলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সা: মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলেন। অতঃপর বললেন, আমীন। এরপর দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন। তখন বললেন, আমীন। তারপর তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন। তখনো বললেন, আমীন। যখন রাসূলুল্লাহ সা: খুতবা ও বয়ান শেষ করে মিম্বর থেকে নামলেন তখন সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:! আমরা আপনাকে মিম্বরে উঠার সময় কিছু বলতে শুনেছি, যা আগে কখনো শুনিনি। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘এইমাত্র জিবরাইল আ: আমার কাছে এসেছিলেন। আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখি, তখন তিনি বললেন, ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে রমজান মাস পেলো; কিন্তু তার গুনাহ মাফ করাতে পারল না। তখন আমি বললাম, আমীন। যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন জিবরাইল আ: বললেন, ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি, যে ব্যক্তি আপনার নাম উচ্চারণ করে; কিন্তু সে আপনার ওপর দরূদ পাঠ করে না। তখন আমি বললাম, আমীন। যখন তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন জিবরাইল আ: বললেন, ধ্বংস হোক ওই ব্যক্তি; যে মা-বাবা উভয়কে অথবা তাদের কোনো একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেলো; কিন্তু তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাল না তখন আমি বললাম, আমীন’ (সুনান আল-কুবরা- ৮৫০৪)।
আমরা রোজা রেখে যদি মিথ্যা কথা বলা ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে না পারি তাহলে আমাদের এ রোজা হবে অনর্থক। বুখারি শরিফের হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও মিথ্যা আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই’ (সহিহ আল-বুখারি-১৯০৩)।
মাহে রমজানের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। এ রমজান মাসের রোজা পালনের মাধ্যমে বান্দার মনে ভয় সৃষ্টি হয়। আল্লাহর কাছে মানমর্যাদা নির্ধারণের একমাত্র উপায় তাকওয়া। এই তাকওয়াই মানুষের মনে সৎ গুণাবলি সৃষ্টি করে। সুতরাং যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে ভালো কাজ করতে পারলেই আমাদের রোজা পালন সার্থক হবে। এই রমজান মাস থেকে আমাদের তাকওয়া শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। মাহে রমজানের রোজা মানুষের স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ সংশোধনপূর্বক প্রকাশ্যভাবে সুন্দর করে দেয় এবং মানুষের পার্থিব লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার ও প্রতারণা প্রভৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আত্মসংযম শিক্ষা দেয়।
লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক


আরো সংবাদ



premium cement