২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সেজদার তাৎপর্য ও স্রষ্টা-ডাকে সাড়া

-

একজন মুমিনের কর্মপরিধি অনেক বিস্তৃত। তিনি এ জগতের স্রষ্টা ও সৃষ্টি নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবনা-নিমগ্ন থাকেন। বহুবিধ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে যখন ক্লান্ত-অবসন্ন বোধ করেন, ঠিক তখনই জগত-স্রষ্টার অনুবর্তী হন। লুটিয়ে পড়েন সেজদায়। তার অক্ষমতা ও জ্ঞানহীনতার কথা অকপটে জানান দেন। কারণ তিনি জানেন, সেজদারত অবস্থায় মুমিন তার রবের সবচেয়ে নিটবর্তী হতে পারে। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেন, ‘সেজদারত অবস্থায় বান্দা আপন রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। সুতরাং এ অবস্থায় তোমরা বেশি করে দোয়া করো।’ (মুসলিম-১৪২৮/৫২১)
তিনি এও জানেন, এই সেজদার মাধ্যমেই একজন মুমিন আপন রবের জন্য দাসত্বের চরমতম পর্যায় উপনীত হন এবং এর দ্বারাই তার সম্মুখে মহাজাগতিক রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হয়।
একজন মুমিন জানেন, তার দেহ মাটি থেকে সৃষ্টি হলেও তার রূহ আকাশের উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। মাটির এ দেহে প্রবেশের আগে তার রূহ কোটি কোটি বছর আকাশের আলোকময় ও পবিত্র প্রাঙ্গণে বিচরণ করছিল। আল্ল­াহর জিকিরের প্রাণময় খাবার খেয়ে সদা প্রাণবন্ত ও সজিব থেকেছে তার রূহ। কিন্তু মাটির দেহ-প্রকোষ্টে যখন তার এই রূহ প্রবেশ করেছে তখন আল্লাহর জিকির থেকে বঞ্চিত হলেই রূহ অশান্ত হয়ে ওঠে। তাই তো আল্লাহ কুরআনে বলেছেনÑ ‘যারা ঈমান এনেছে তাদের আত্মা আল্লাহর জিকিরেই প্রশান্তি অনুভব করে। সুতরাং যেনে রাখো; আল্লাহর জিকিরেই আত্মার প্রশান্তি নিহিত।’ (সূরা রাদ-২৮)
একজন দ্বীপ্তিমান মুমিন স্রষ্টার জিকিরের পৌনঃপুনিকতায় আবর্তিত হন। কারণ তিনি জানেন, স্রষ্টার পথের অনন্য পাথেয় হলো তার জিকির এবং এই জিকিরই হলো তওবার অন্তর্গত সঞ্জীবনী শক্তি। তাই তো একজন মুমিন জীবনের দিন-ক্ষণের জিকিরবিহীন অতিক্রমণে চরম অস্থিরতায় নিমজ্জিত হন।
‘এসো নামাজের জন্য এসো’ ‘এসো কল্যাণের পথে এসো’ স্বীয় প্রভুর এ মায়াময় আহ্বানে চরমভাবে পুলকিত হন মুমিন এবং ভাবেন এ আহ্বান কেবল তাকেই উদ্দেশ্য করে। তখন তার আর দেরি সয় না। পার্থিব সব দায়-দায়িত্ব ও ভালো লাগা-ভালোবাসার বাধন ছিন্ন করে আপন রবের কাছে সমর্পণ করেন তার সমুদয় অস্থিত্ব। কারণ তিনি তার প্রভুর ভালোবাসা ও তার ডাকে সাড়া দেয়ার প্রবল ইচ্ছা সম্পর্কে এ হাদিসটিও জানেন। যেখানে রাসূল সা: একটি কুদসি হাদিসে বলেছেনÑ ‘আমার প্রতি আমার বান্দা যেরূপ ধারণা করে আমি তার প্রতি সেরূপ আচরণ করি। আমার বান্দা যখনই আমাকে স্মরণ করে, আমি তখনই তার ডাকে সাড়া দেই। এ ক্ষেত্রে যে আমায় স্মরণ করে মনে মনে, আমি তাকেও মনে মনে স্মরণ করি। যে আমাকে মানুষের জমায়েতে সামনে স্মরণ করে, আমিও তাকে এর চেয়ে উত্তম (ফেরেশতাদের) জমায়েতে স্মরণ করি। যে আমার দিকে এক বিঘত পরিমাণ এগিয়ে আসে আমি তার দিকে এক হাত পরিমাণ নিকটবর্তী হই। আর যে বান্দা এক হাত পরিমাণ নিকটবর্তী হয়, আমি দুই হাত পরিমাণ তার দিকে অস্রসর হই। আর যে আমার দিকে হেঁটে আসবে,আমি আল্লাহ তার দিকে দৌঁড়ে আসি।’ (মুসলিম-৪৯৬১)
মুমিন ব্যক্তি তার রবের ক্ষমাশীলতা ও তার নিঃসীম ক্ষমতা সম্পর্কে বর্ণিত এ হাদিসটিও জানেনÑ যেখানে বলা হয়েছে, ‘হে আমার বান্দাগণ! আমি আমার জন্য জুলুম হারাম করেছি, তাই তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি, সুতরাং তোমরা পরস্পরকে জুলুম করো না। হে আমার বান্দারা! আমি যাদের হেদায়াত দিয়েছি তারা ছাড়া তোমরা সবাই পথহারা, তাই আমার কাছে হেদায়াত চাও আমি তোমাদের হেদায়াত দেবো। হে আমার বান্দারা! আমি যাদের আহার দিয়েছি তারা ব্যতীত তোমরা সবাই অভুক্ত, তাই আমার কাছে আহার চাও, আমি তোমাদের আহার দেবো। হে আমার বান্দারা! আমি যাদের পোশাক দিয়েছি তারাই প্রকৃতই পোশাকাবৃত। তাই তোমরা আমার কাছে পোশাক চাও আমি তোমাদের পোশাক দেবো। হে আমার বান্দারা! তোমরা দিন-রাত গোনাহ কর আর আমি তোমাদের গোনাহের কোনো কিছু ভ্রুক্ষেপ না করেই তোমাদের সেসব গোনাহ মাফ করে দেই। তাই তোমরা মাফ চাও আমি মাফ করে দেবো। হে আমার বান্দারা! তোমরা আমার ক্ষতি সাধনের পর্যায়ে যেতে পারবে না, তাই আমার ক্ষতিও করতে পারবে না। আবার আমার উপকার করার পর্যায়েও যেতে পারবে না, তাই আমার উপকারও করতে পারবে না। হে আমার বান্দারা! সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে শেষ পর্যন্ত যত মানুষ ও জিন জাতি আসবে তারা সবাই সর্বোচ্চ মাত্রার পরিচ্ছন্ন (ঈমানি) হৃদয়ের অধিকারীও যদি হয়ে যায়, তাতে আমার রাজত্বে ন্যূনতম বৃদ্ধি-সমৃদ্ধি ঘটবে না। একইভাবে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে শেষ পর্যন্ত যত মানুষ ও জিন জাতি আসবে তারা সবাই যদি সর্বোচ্চ মাত্রার জালিম ও অন্যায় প্রবণ হৃদয়ের অধিকারী হয়ে যায়, তাতে আমার রাজত্ব এতটুকু হ্রাসপ্রাপ্ত হবে না। হে আমার বান্দারা! এ যাবত যত জিন ও ইনসান সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি হয়েছে তারা সবাই যদি এক জায়গায় সমবেত হয়ে আমার কাছে তাদের নিজ নিজ চাওয়া-চাহিদা পেশ করে এবং আমি তা এক এক করে পূর্ণ করে দেই, তবুও আমার সম্পদ-ভাণ্ডারে কোনো কমতি ঘটাবে না। সাগরের মধ্যে সুঁই ডোবালে যেমন সাগরের পানির কমতি হয় না, ঠিক তেমনি তোমাদের চাওয়া-চাহিদা পূর্ণকরণে আমার সম্পদের কোনোই কমতি হবে না। হে আমার বান্দারা! পরকালে মূলত তোমাদের কৃত আমলেরই ফলাফল আমি তোমাদের পূর্ণভাবে বুঝিয়ে দেবো। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে কল্যাণ প্রাপ্ত হবে সে যেন আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়, আর যে অকল্যাণপ্রাপ্ত হবে সে যেন নিজেকেই দোষারোপ করে।’ (মুসলিম-৪৮০২)
যবে থেকে এই দীপ্তিমান মুমিন শুনেছেন এ সব হাদিস, তখন থেকেই তিনি স্রষ্টা-প্রীতির অমিয়-ধারায় সিক্ত হয়ে সব ইহলৌকিতাকে পায়ে ঠেলে পরম মমতাময়ী সৃষ্টার ডাকে অবিরত এক অনন্য প্রণোদনায় সাড়া দিয়ে আসছেন।
লেখক : প্রফেসর ও সভাপতি আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


আরো সংবাদ



premium cement