২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তকদিরে বিশ্বাসের মর্মকথা

-

তকদিরে বিশ্বাস ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঈমান আনার জন্য তকদিরে বিশ্বাস জরুরি।
ইমাম ত্বহাবী র:-এর আকিদাতুত ত্বহাবিয়্যাহর ৫২ নং পয়েন্টে তিনি বলেছেন যে, ‘যা সংঘটিত হবে বলে আল্লাহ তায়ালা লাওহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন তা যদি সব সৃষ্টি একত্র হয়েও রোধ করতে চায়, তাহলেও তারা সেটা করতে সক্ষম হবে না। এর বিপরীতে, আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা লাওহে মাহফুজে যা সংঘটিত হওয়ার কথা লিখে রাখেননি সব সৃষ্টি একত্র হয়েও তা ঘটাতে পারবে না, কিয়ামত দিবস পর্যন্ত যা ঘটবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়ে গেছে, কলমের কালি শুকিয়ে গেছে।’
যাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, শুরাকা বিন মালিক বিন জুশম আগমন করে বলল, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের জন্য আমাদের দ্বীনের বিষয়গুলো এভাবে বর্ণনা করুন যে মনে করবেন আমাদের কেবল এইমাত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। আজ আমরা কিসের জন্য আমল করব? ওই বিষয়ের জন্য যা লেখার পর কলমের কালি শুকিয়ে গেছে এবং তকদির নির্ধারণ হয়ে গেছে নাকি আমরা ওই বিষয়ের জন্য আমল করছি যা ভবিষ্যৎ এ নির্ধারণ করা হবে?’ জবাবে রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘না, বরং তোমরা ওই বিষয়ের জন্য আমল করছ যা লেখার পর কলমের কালি শুকিয়ে গেছে এবং তাকদির নির্ধারণ করা হয়ে গেছে।’
অর্থাৎ যে তকদির নির্ধারণ করা হয়ে গেছে সেটার জন্যই আমরা আমল করছি। এর মানে হলো, কী লেখা হয়ে গেছে আমরা সেটা জানি না, আমাদের জন্য যেটা কল্যাণকর সেটাকে কেন্দ্র করে আমরা কাজ করে যাবো।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘জেনে রাখো, দুনিয়ার সব মানুষ মিলেও যদি তোমার কোনো উপকার করতে চায় তথাপি তারা শুধু তোমার ততটুকু উপকারই করতে পারবে যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি তারা মিলিত হয়ে তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায় তথাপি তারা শুধু সেই পরিমাণই ক্ষতি করতে পারবে যা আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা তোমার ওপর লিখে দিয়েছেন। যা কিছু লেখার ছিল তা লেখার পর কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং কিতাবে লেখার পর কালি শুকিয়ে গেছে।’ ইমাম তিরমিজি। ইমাম আলবানিসহ সবাই হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।
মুসনাদে আহমদের রেওয়াতে এভাবে এসেছে যে, ‘তুমি আল্লাহর হকসমূহের হেফাজত করে চলো তাহলে আল্লাহকে সামনে পাবে, স্বাচ্ছন্দ্যের সময় তুমি আল্লাহকে চিনবে তাহলে আল্লাহ তোমাকে কষ্টের সময় চিনবেন। স্বাচ্ছন্দ্যের সময় আল্লাহকে স্মরণে রাখবে তাহলে আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা তোমাকে কষ্টের সময় স্মরণে রাখবেন। তুমি এ কথা বিশ্বাস করবে যে, তোমার জীবনে যা ঘটেনি তা ঘটারই ছিল না। আর যা ঘটেছে তা তোমার জীবনে ঘটারই ছিল। জেনে রাখো, সবরের সাথেই বিজয়, আপদ বিপদের পরেই মুক্তি এবং দুঃখের পরেই সুখ।’ (আবু দাউদ)
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘হে বালক, তুমি মনে রেখো, তোমার সাথে যা ঘটার তা ঘটবেই। তা তোমার শুধু কর্মের কারণেই ঘটেছে বিষয়টা এমন নয়।’ (আবু দাউদ)
এতে করে আমরা বুঝি আমরা শুধু আমাদের কর্মের ফলই পেয়ে থাকি না, বরং আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালার নির্ধারণও আমরা পাই।
ইমাম শাফিঈ রহ: বলেছেন, ‘মানুষকে সন্তুষ্ট করার বিষয়টি এই যে কেউ এর শেষ সীমায় পৌঁছাতে পারবে না। অর্থাৎ মানুষ মানুষকে কখনো সন্তুষ্ট করতে পারবে না। সুতরাং যে কাজ করলে আপনি উপকৃত হবেন তাই করা আবশ্যক। এছাড়া অন্যান্য কাজে নিজেকে ব্যস্ত করবেন না। সব সৃষ্টিকে সন্তুষ্ট করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়, আপনাকে এ ব্যাপারে আদেশও করা হয়নি। আমাদের রব যেহেতু একমাত্র আল্লাহ তাই তাকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব, তার আদেশও আপনাকে করা হয়েছে। মাখলুককে ভয় করে কী লাভ। কোনো মাখলুকই আল্লাহর মোকাবেলায় আপনার কোনো উপকারে আসবে না।’
ইমাম ত্বহাবী রহ: পরের ৫৩ নং পয়েন্টে বলেছেন, ‘যা বান্দাহর তকদিরে লেখা হয়নি তা সে কখনোই পাবে না। আর যা বান্দাহর তকদিরে লেখা আছে তা কখনোই বাদ পড়বে না।’
রাসূলুল্লাহ সা: স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘তোমার তকদিরে যা ছিল তাই তুমি পাবে আর যা নেই তা তোমার সাথে হবে না। যখন তোমার সাথে খারাপ কিছু হবে। তখন বলবে না যদি এমন এমন করতাম তবে এমন হতো, তখন তুমি বলবে আল্লাহ আমার তকদিরে এটাই রেখেছেন, তাই এটাই হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, তুমি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। না, বরং তুমি যেটাকে কল্যাণকর মনে করো সেটার জন্য চেষ্টা করবে।’
অর্থাৎ আমরা যেটাকে কল্যাণকর মনে করি আমরা সেটার জন্য চেষ্টা করব। চেষ্টা করার পর যদি আমরা পাই আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করব, যদি না পাই তাহলে আমরা বলব, আমাদের তকদিরে এটা ছিল না তাই আমরা এটা পাইনি।
ইমাম ত্বহাবী রহ: তার পরের পয়েন্টে বলেন যে, ‘বান্দাহর এ কথা জেনে রাখা কর্তব্য যে, তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তারা যাবতীয় ঘটনাবলি সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা আগে থেকেই অবহিত। অতঃপর তিনি সেটাকে অকাট্য ও অবিচল তাকদির হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। আসমানে জমিনের কোনো মাখলুক এটাকে বাতিল করতে পারে না বা এর বিরোধিতা করতে পারে না এবং এর বিরোধিতাকারী কেউই নয়। একে অপসারণ বা পরিবর্তন করতে পারে না, একে সঙ্কোচন বা পরিবর্ধন করাও কারো পক্ষে সম্ভব নয়।’
সহিহ বুখারির হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা আসমান ও জমিন সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর আগে সব মাখলুকের তকদির লিখে দিয়েছেন। তখন তার আরশ ছিল তার পানির ওপর।’
ইমাম ত্বহাবী রহ: আরো বলেন, ‘আর এটাই হচ্ছে ঈমানের দৃঢ়তা আর মারেফাতের (পরিচয়) মূল বস্তু এবং আল্লাহ তায়ালার তৌহিদ আর রুবুবিয়্যাহ সম্পর্কে স্বীকৃতি প্রদান।’
অর্থাৎ তকদিরের ওপর বিশ্বাসই হচ্ছে ঈমানের দৃঢ়তা। অর্থাৎ তাকদিরের প্রতি যার বিশ্বাস এমন নয় তার ঈমান দৃঢ় নয়। আল্লাহ তায়ালার তাওহিদ আর রুবুবিয়্যাহতের স্বীকৃতি প্রদান যেমনটা আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাবে ঘোষণা দিয়েছে যে, ‘তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন এবং যথাযথ অনুপাত অনুসারে পরিমিত করেছেন।’
আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেছেন, ‘আল্লাহর বিধান সুনির্ধারিত।’
রাসূলুল্লাহ সা:-কে হাদিসে জিব্রাঈল এ ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘তুমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে আল্লাহর ওপর, তাঁর রাসূলের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর, কিতাবের ওপর, আখিরাতের ওপর এবং তকদিরের ভালো মন্দের ওপর (ওয়াল কাদরি খাইরিহি ওয়া কারোহি)।’
এখানে রাসূল সা: তকদিরে বিশ্বাস (ওয়াল তু’মিনু বিল কাদরি) বলে থেমে যাননি, তিনি বলেন, খাইরিহি ওয়া শাররিহি অর্থাৎ এর ভালো মন্দের ওপরও বিশ্বাস রাখতে হবে। যদি তকদির এমনই একটা জিনিস হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তায়ালা বান্দাহরটা জানেন তাই লিখে রেখেছেন এর কম বেশি কিছু না, তাহলে এর ভালো মন্দ বলার কোনো মানে নেই। তার মানে তকদিরে যা ভালো লেখা হয়েছে তা আমার সাথে হবে, যা খারাপ লেখা হয়েছে তাও আমার সাথে হবে, এর ব্যতিক্রম হবে না। এটার প্রতি বিশ্বাস হলো এখানে মূল পয়েন্ট যে, এর ব্যতিক্রম হবে না। তকদিরের বিষয়টা কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। যারা তকদিরে অবিশ্বাস করে তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের বাইরে।
ইমাম ত্বহাবী রহ: আলোচনার প্রায় শেষ ভাগে বলেন, ‘অতএব সে ব্যক্তির ধ্বংস অনিবার্য যে তকদির সম্পর্কে আল্লাহর বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছে এবং রোগাক্রান্ত অন্তর নিয়ে এ বিষয়ে আলোচনায় লিপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই সে স্বীয় ধারণা অনুযায়ী গায়েবের একটি গুপ্ত রহস্য সম্পর্কে অনুধাবন করেছে। আর এ সম্পর্কে সে যা মন্তব্য করেছে যার ফলে সে মিথ্যাবাদী ও পাপাচারিতায় পতিত হয়েছে।’
অর্থাৎ তকদির এমন একটি বিষয় আমরা জানি যে, সেটা গায়েবি বিষয়। এখানে আমরা শুধু ততটুকুই বলতে পারব যতটুকু আল্লাহ এবং তার রাসূল সা: বলেছেন। এর ব্যতিক্রম আমরা কিছুই বলতে পারব না, আমরা এর ব্যতিক্রম কিছুই জানি না। আমরা তকদিরের আলোচনা সম্পর্কে কোনো যুক্তি দিয়ে, তর্ক দিয়ে কোনো কথা বলতে পারব না।
আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা আমাদের তকদিরের সঠিক জ্ঞান এবং সঠিক আকিদায় মৃত্যুবরণ করার তাওফিক দান করেন। আমীন।

 


আরো সংবাদ



premium cement