হাজারো বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিয়ে স্বমহিমায় পাহাড় ঘেরা মনোরম পরিবেশে অবস্থান লেবাননের। অনেকবারই যুদ্ধের কবলে পড়েছে বহু ধর্মাবলম্বী মানুষের এ দেশ। কিন্তু তারপরও নিজেকে ফিরিয়ে আনার তাগিদ সবসময়ই ছিল ভূমধ্যসাগরের পাড়ে অবস্থিত পশ্চিম এশিয়ার এ দেশটির।
বৈচিত্র্যময় ইতিহাস-ঐতিহ্য যেমন দেশটিকে ঘিরে রেখেছে, তেমনিভাবে বাস্তব সীমানা দিয়ে একে ঘিরে রেখেছে সিরিয়া ও ইসরাইল। লেবাননের ধর্মীয় পরিস্থিতি যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি এর রাজনৈতিক বণ্টনটিও অবাক করা। দেশটিতে ১৮টি ধর্মের লোক বাস করে। এর মধ্যে প্রধান তিনটি গোত্রের মধ্যে বণ্টিত হয়েছে দেশের শীর্ষ পদগুলো। লেবাননের সংবিধান অনুসারে দেশটির প্রেসিডেন্ট হবেন একজন খ্রীস্টান প্রধানমন্ত্রী হবেন মুসলমানদের সুন্নি সমাজের এবং স্পিকার হবেন শিয়া সম্প্রদায় থেকে। পার্লামেন্টের আসনগুলোর অর্ধেক খ্রিষ্টান ও অর্ধেক মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত। লেবাননের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল গোষ্ঠী বা গোত্রভিত্তিক। ধর্মীয় জনসংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতে ক্ষমতাবণ্টনের এ রকম রীতি লেবানন ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও দৃশ্যমান হয় না।
লেবানন বড় দাগে যেসব সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ইসরাইলের সাথে সঙ্ঘাত ও গৃহযুদ্ধ। ১৯৭৮ সালের ১৪ মার্চ তারিখে ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স (ওউঋ) দক্ষিণ লেবানন আক্রমণ করে। পরে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় এ যুদ্ধ থেমে যায়। ১৯৮২ সালের ৬ জুন তারিখে পুনরায় ইসরাইল লেবানন আক্রমণ করে। লেবাননের নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও শিয়া মতাবলম্বী সংগঠন হিজবুল্লাহ প্রত্যক্ষভাবে এ যুদ্ধে অংশ নেয়। এ যুদ্ধে ইসরাইল দক্ষিণ লেবাননের বিশাল অংশ দখল করে। পরে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বিরতি হয় এবং ১৯৮২ সালের ২৬ জুন তারিখে ইসরাইল সেনাবাহিনী লেবানন ত্যাগ করে। একই বছরের ১৩ জুলাই তারিখে ইসরাইল ও লেবাননের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর দীর্ঘ দিন পর ২০০৬ সালের ১২ জুলাই আবারো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইসরাইল-লেবানন। ১৪ আগস্ট জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলে যুদ্ধ বন্ধ হয়।
আর দেশটিতে গৃহযুদ্ধের ইতিহাস ১৯৭৫ সাল থেকে। এর এক বছর পর সিরীয় সৈন্যরা দেশটিতে প্রবেশ করে। তাদের যুক্তি ছিল, লেবাননের তিক্ত সংঘাত থেকে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য তারা সেখানে ঢুকেছে। বৈরুতের ৩০ মাইল দূরে লেবাননের উত্তরাঞ্চলে চার হাজার সৈন্য এবং ২০০ ট্যাংক তখন মোতায়েন করা হয়। পরে তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল অন্যান্য আরব দেশ থেকে যাওয়া সৈন্যরাও। গঠন করা হয়েছিল আরব প্রতিরোধ বাহিনী নামে একটি সেনাদল। কিন্তু তাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও লেবাননে আরো ১৪ বছর গৃহযুদ্ধ চলে। ১৯৯০ সালে তায়েফ চুক্তির মাধ্যমে এ গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এর পরেও সিরীয় সৈন্যরা লেবাননে থেকে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সিরিয়া আর লেবাননের মধ্যে একটা মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার আওতায় প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতিবিষয়ক যৌথ সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এরপর ২০০৪ সালে লেবানন থেকে অ-লেবাননি সব সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে জাতিসঙ্ঘে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু সিরীয় সৈন্যরা থেকে যায় এরপরেও। পরের বছরের ৫ মার্চ বাশার আল আসাদ সিরিয়ার পার্লামেন্টে লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। এর ছয় সপ্তাহ পর ২০০৫ সালের ২৬ এপ্রিল শেষ সিরীয় সৈন্য লেবানন ছেড়ে যায়।
এসব যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সাহায্যের মাধ্যমে লেবানন নিজের সঙ্কট দূর করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। শুরু হয় দেশ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া লেবাননের জন্য এটি ছিল খুবই কঠিন একটি কাজ। সে সময় দেশটির জনগণ রফিক হারিরিকে তাদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে। ১৯৯২ থেকে শুরু করে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এবং পরে আরেক দফায় ২০০০ থেকে শুরু করে ২০০৪ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত রফিক হারিরি এ দায়িত্ব পালন করেন। লেবানন বিশেষ করে বৈরুত পুনর্গঠনের দিকেই মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন বৈরুতকে। নিজস্ব বিদ্যুৎ ও ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন শহরটিকে। কিছু জায়গায় তৈরি করা হয়েছিল ভূগর্ভস্থ টানেল। মসজিদ-গির্জাসহ বিশেষ বিশেষ স্থাপত্যে সাজিয়ে তুলেছিলেন রাজধানী শহরটিকে। এ সময়ের মধ্যে তিনি বৈরুতের যে পুনর্গঠন করেছিলেন তাতে অনেকে শহরটির পরিবর্তিত রূপকে ফিনিক্সের সাথে তুলনা করতে থাকেন। অনেকে বলতে শুরু করেন, রফিক হারিরি বৈরুতকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু তার বিরোধীরা অভিযোগ করেছিল, তিনি বিশেষ কিছু জায়গাতেই কেবল তার পুনর্গঠন কার্য চালিয়ে যাচ্ছেন। বাকি স্থানগুলোতে অবস্থা খুবই খারাপ। বিশেষত রফিক হারিরি সাধারণ লোকজনকে নির্মূল করেছিলেন এবং সে পরিস্থিতি ছিল যুদ্ধের চেয়েও খারাপ। তাদের মতে, লেবাননের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির সময়ও পরিস্থিতি এর চেয়ে ভালো নয়। কারণ তারা নিজেরা থাকেন সুরক্ষিত স্থানে। কিন্তু বাকি অধিবাসীদের অবস্থা তারা বিবেচনা করেন না। সমালোচকদের একজন বৈরুতের অ্যামেরিকান ইউনিভার্সিটির শহর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক মোনা ফাওয়াজ বলেন, পুনর্নির্মাণের নামে আসলে শহরটিকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। যুদ্ধে যতটুকু ক্ষতি হয়েছিল, পুনর্গঠনের নামে তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করা হয়েছে এ অঞ্চলের। হ