৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দুদক কেন সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতি ঠেকাতে পারছে না?

সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়। সেসব অভিযোগ তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

কিন্তু বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ হচ্ছে, ক্ষমতাশালী শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে তারা কেবল মধ্যম ও নিম্নসারির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন,‘অবস্থা দেখা মনে হচ্ছে, দুদকের কর্মকর্তারা হয়তো একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে নিয়েছেন, যেটার ওপরে তারা যেতে চায় না।’

যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে দুদক বলছে, দুর্নীতির প্রশ্নে তারা কাউকেই ছাড় দেন না।

দুদকের কমিশনার মো: জহুরুল হক বলেন,‘অভিযোগ পেলেই আমরা তদন্ত করে দেখি এবং প্রমাণ পেলে সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।’

যদিও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের যে অভিযোগ সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখার বিষয়ে এখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি দুদককে।

দুর্নীতিতে কারা কতটুকু এগিয়ে?
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সার্বিকভাবে দুর্নীতি বেড়েছে বলে জানাচ্ছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)।

বার্লিনভিত্তিক সংস্থাটি ২০২৩ সালে দুর্নীতির যে ধারণাসূচক প্রকাশ করেছে, সেখানে আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ নিচে নেমে গেছে বাংলাদেশ।

সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন দশম।

টিআই এটাও বলছে যে, বিশ্বে যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই এবং যারা কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে রয়েছে, সেসব দেশের চেয়েও বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যাচ্ছে।

এক্ষেত্রে সরকারের কোন খাতে কতটা দুর্নীতি হচ্ছে, সে বিষয়ে ধারণা দিতে দুই বছর আগে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

সেখানে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা।

তাদের কাছে সেবা নিতে গিয়ে দেশের ৭৪ শতাংশেরও বেশি সংখ্যক পরিবার দুর্নীতির শিকার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি পাওয়া গেছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ে।

সেবা নিতে গিয়ে পাসপোর্ট অধিদফতরে ৭০.৫ শতাংশ এবং বিআরটিএ কার্যালয়ে ৬৮.৩ শতাংশ পরিবারকে বাধ্য হয়ে ঘুস দিতে হয়েছে।

এছাড়া বিচারিক সেবাখাতে ৫৬.৮ শতাংশ, সরকারি স্বাস্থ্য সেবায় ৪৮.৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৪৬.৬ শতাংশ এবং ভূমি সেবায় ৪৬.৩ শতাংশ পরিবার দুর্নীতির শিকার হয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

সরকারি কার্যালয়গুলোতে যে দুর্নীতি হচ্ছে, দুদকও সেটি স্বীকার করছে।

দুদকের কমিশনার মো: জহুরুল হক বলেন,‘সরকারি সেবাখাতে যে দুর্নীতি হচ্ছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই যে অবৈধ সম্পদের মালিক হচ্ছেন, সেটাই বাস্তবতা।’

এ ধরনের দুর্নীতি বন্ধে দুদক কী করছে?

জহুরুল হক বলেন,‘তথ্য পেলেই আমরা তদন্ত করছি। এছাড়া হাতেনাতে ধরার জন্য ঘটনাস্থলে অভিযান চালানো, ফাঁদ পাতাসহ আরও অনেক ধরনের ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি।’

‘চুনোপুঁটি’ই বেশি
দুদকের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শতাধিক দুর্নীতির মামলায় প্রায় ৩৭৪ জনকে আসামি করা হয়েছে, যাদের অর্ধেকই সরকারি চাকরিজীবী।

তাদের পরিচয় পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, আসামিদের মধ্যে ৯৬ শতাংশই মধ্যম ও নিম্নসারির কর্তকর্তা-কর্মচারী।

উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন মাত্র চার শতাংশের মতো।

এর আগের অন্তত সাত বছরের তথ্য পর্যালোচনা করেও কাছাকাছি ধরনের চিত্র পাওয়া গেছে।

এছাড়া উচ্চপদস্থ যে ক’জনকে আসামি করা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় দেখা যাচ্ছে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই আবার ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন,‘রাঘব বোয়ালের তুলনায় চুনোপুঁটি ধরা সহজ এবং নিরাপদ। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ক্ষমতাবলয়ের বাইরে অবস্থান করে।’

করোনা মহামারীর সময় দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাত বেশ আলোচনায় ছিল।

তখন মাস্ক কেলেঙ্কারি, কোভিড টেস্ট নিয়ে জালিয়াতি, জনবল নিয়োগে কোটি টাকা ঘুস প্রস্তাব, যন্ত্রপাতি কেনা-কাটায় শত শত কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে।

কিন্তু এসব ঘটনায় উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা গ্রেফতার হননি। গ্রেফতার হয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আবদুল মালেক ও কর্মচারি আবজাল হোসেন।

একইভাবে ভূমি অফিস, রাজউক কিংবা সিটি করপেরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা গ্রেফতারের নজির খুব একটা নেই বলে জানাচ্ছে টিআইবি।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন,‘যেখানে দুর্নীতি বা অনিয়মে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এরকম ক্ষেত্রে খুব কমই আমরা কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাই।’

তিনি আরো বলেন,‘বড় জোর হয়তো বদলি করা হয়, যা আসলে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না।’

এছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচার করার অভিযোগও রয়েছে।

কানাডায় অর্থপাচার করে বাংলাদেশী নাগরিকদের বাড়ি-গাড়ি কেনার বিষয়ে ২০২০ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন,‘আমাদের সচরাচর ধারণা যে, এগুলো হয়তো রাজনীতিবিদরা করেন। কিন্তু, সেখানে দেখা গেল এদের অধিক সংখ্যক সরকারি চাকরি করেন।’

কিন্তু কারা সেই অর্থপাচারকারী, সেটি এখনও বের করতে পারেনি দুদক।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে তারা সরকারি যত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জনকে অবশ্য আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় বরখাস্ত হওয়া পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক মিজানুর রহমানকে ২০২৩ সালে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত, যা নিজেদের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে দেখছে দুদক।

একই অভিযোগে সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত সচিব প্রশান্ত কুমার রায়কে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়েছে।

সদিচ্ছার অভাব
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আইনগতভাবে সব ধরনের ক্ষমতা দেওয়ার পর কেবল সদিচ্ছার অভাবে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে দুর্নীতির লাগাম টানতে পারছে না দুদক।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন,‘আইন তাদের সব ধরনের ক্ষমতা দিয়েছে, এমনকি প্রোটেকশনও দিয়েছে। তারপরও যদি তারা দুর্নীতির লাগাম টানতে না পারে, সেটি খুবই দুভাগ্যজনক।’

আইন অনুযায়ী, দুদকের চেয়ারম্যান বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির সমমানের পদমর্যাদা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকেন।

আর দুই কমিশনার ভোগ করেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির পদমর্যাদা।

ইমাম মজুমদার বলেন,‘এমনকি মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ চাইলেই হুট করে তাদেরকে অপসারণ করতে পারবে না। আইনে এতটাই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।’

সুতরাং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন তিনি।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, উনারা নিজেরাই ক্ষমতাশালী মহলের সাথে সখ্য রাখতে চান কিংবা ভয় থেকে হয়তো তাদের ঘাঁটাতে যান না। সে কারণেই তাদেরকে ছাড় দেন, যা খুবই দুঃখজনক।’

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইমাম মজুমদার বলেন,‘উনাদের মধ্যে সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন না করে উনারা কাজ করেন দায়সারাভাবে। এটাই বড় সমস্যা।’

ক্ষমতার বলয়ে জিম্মি
দুদককে কেন্দ্র করে ক্ষমতার একটি বলয় তৈরি হয়েছে, যারা প্রতিষ্ঠানটিকে জিম্মি করে রেখেছেন বলে মনে করছেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের প্রশাসনে যারা কাজ করছেন, তারাই দেখা যাচ্ছে দুদকের শীর্ষ পদগুলোতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অনেকেই তাদের পরিচিত মানুষ।’

আর পরিচিত হওয়ার কারণেই তারা অনেক সময় একে অন্যের স্বার্থ দেখছেন, যা দুদকের কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে বলে মনে করেন তিনি।

আবার দুদকে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কর্মকর্তাদের অনেকে সরকারি অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন।

তেমন ক্ষেত্রে যেন ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পান, সেটি মাথায় রেখেও কেউ কেউ প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলেন বলে মনে করছেন তিনি।

সর্ষের ভূত
বাংলাদেশে দুর্নীতির তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব যাদের ওপর, সেই দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই অতীতে বিভিন্ন সময় দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে দেখা গেছে।

অর্থপাচারের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের কাছ থেকে দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের ৪০ লাখ টাকা ঘুস নেয়ার ঘটনায় রীতিমত উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল।

পরে অবশ্য দুদক নিজেই অভিযোগ তদন্ত করেছে এবং তাদের দু'জনকেই শাস্তির আওতায় এনেছে, যা দুর্নীতি বিরোধী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে।

আবার দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে দুদকের একজন কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছেন, তেমন নজিরও রয়েছে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়াসহ দুর্নীতির বিভিন্ন ঘটনা তদন্ত করে আলোচনায় এসেছিলেন দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন।

চাকরিচ্যুত হওয়া উদ্দিন অবশ্য পরে দুদক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই নানান অভিযোগ তোলেন।

তিনি দাবি করেন, বড় বড় কয়েকটি দুর্নীতির মামলার তদন্ত করে তিনি অনেক আমলা ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিলেন।

সেজন্যই তিনি প্রভাবশালী মহলের রোষানলের শিকার হয়েছেন।

যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে দুদক তখন বলেছিল যে, উদ্দিনের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ থাকায় তাকে কর্তৃপক্ষ অপসারণে বাধ্য হয়েছে।

ইমাম মজুমদার বলেন, দুদকের ভেতরেই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে তারা কীভাবে কাজ করবে? মানুষ তাদের উপরেই-বা আস্থা রাখবে কীভাবে? ভূত তো সর্ষের মধ্যেই।’

পরামর্শ দিয়ে তিনি আরো বলেন, নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করে মানুষের আস্থা অর্জন করতে যা যা করণীয়, সেগুলোর দিকে দুদকের নজর দেওয়া উচিৎ।’

দমনের হাতিয়ার
সরকার বিরোধীদের দমনের উদ্দেশ্যেও অনেক সময় দুদককে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলটির অনেক নেতার বিরুদ্ধেই দুদকে একাধিক মামলা রয়েছে।

এসব মামলায় খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।

বিএনপির শুরু থেকেই এসব মামলাকে‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ বলে দাবি করে আসছে।

অন্যদিকে, দুদকের করা অর্থ আত্মসাতের মামলায় সম্প্রতি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে দ্বন্দ্বের জেরে অধ্যাপক ইউনূসকে দুদকের মামলায় জড়ানো হয়েছে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন,‘আবার ক্ষমতাসীনদের সুনজরে থাকার কারণে অনেকে দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন।’

তিনি আরো বলেন,‘আমরা চাই, দুর্নীতিবাজ সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক। কেউই যেন ছাড় না পায়।’

কী বলছে দুদক?
ওপরের সব অভিযোগ অস্বীকার করে দুদক বলছে, নিরপেক্ষতা বজায় রেখে স্বাধীনভাবেই কাজ করছে তারা।


দুদকের কমিশনার মো: জহুরুল হক বলেন,‘দুর্নীতি ঠেকাতে আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

তিনি বলেন,‘এক্ষেত্রে আমরা কারো ক্ষমতা বা রাজনৈতিক পরিচয় যেমন বিবেচনা করি না, তেমনি প্রমাণ না থাকলে কাউকে অহেতুক হয়রানি করি না।’

তিনি আরো বলেন, তবে দুর্নীতি করেও যে সরকারের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী পার পেয়ে যাচ্ছেন, সেটা স্বীকার করছেন।

‘তথ্য পেলেই আমরা খতিয়ে দেখি। তবে এটাও ঠিক যে সব সময় প্রমাণ পাওয়া যায় না।’

হক বলেন, আর প্রমাণ না পাওয়া গেলে আমাদের কিছু করার থাকে না।

এদিকে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের তুলনায় সরকারের মধ্যম ও নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুদকের মামলায় বেশি গ্রেফতার হওয়ার কারণ সম্পর্কে দুদকের আইনজীবীর কাছে প্রশ্ন করেছিল।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন,‘বড়-ছোট বলে কোনো কথা নেই। দুর্নীতি ইজ দুর্নীতি।’

খান বলেন, কাজেই ছোটদের ধরতে পারছেন, বড়দের পারছেন না- এসব প্রশ্ন অবান্তর। যার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাচ্ছি, তাকেই আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিচ্ছি।

তার এই কথার প্রেক্ষিতে সাবেক মন্ত্রপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, অবশ্যই দুর্নীতিবাজ সকল ব্যক্তি সমান অপরাধী। তবে নিম্নস্তরের চেয়ে উচ্চস্তরে দুর্নীতির টাকার লেনদেনের পরিমাণ অনেক বেশি।

মজুমদার বলেন, কাজেই বড় দুর্নীতি থামানোর প্রতিও দুদকের নজর দিতে হবে।’

বেনজীরের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত হবে?
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের যে অভিযোগ উঠেছে, সেটির বিষয়ে দ্রুত তদন্ত শুরু করা উচিৎ বলে মনে করছেন দুর্নীতি বিরোধী ব্যক্তিরা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন,‘যেহেতু বিষয়টি সামনে এসেছে, সেহেতু ঘটনাটি সত্য কি না দুদকের উচিৎ দ্রুত সেটি খুঁজে বের করা।’

এক্ষেত্রে দুদক স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রকাশিত তথ্য যাচাইয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন,‘এটা খতিয়ে দেখা দুদকের দায়িত্ব। তারা যদি দ্রুত সক্রিয়তা না দেখায়, তাহলে দুর্নীতি দমনে দুদকের ভূমিকা নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠবে, যা প্রতিষ্ঠানটিকে আরো আস্থার সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিবে।’

অন্যদিকে, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া অভিযোগের বিষয়ে দুদক তৎপরতা না দেখালে, সেটি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে বলে মনে করছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার।

তিনি বলেন,‘এরকম ঘটনায় দুদক যদি নীরব থাকে, তাহলে সরকারি চাকরিজীবীরা তো বটেই, অন্যরাও অনিয়ম-দুর্নীতি করার ক্ষেত্রে উৎসাহ পাবে।’

কাজেই মজুমদারও মনে করছেন, বিষয়টি নিয়ে দুদকের দ্রুত তদন্ত শুরু করা উচিৎ।

তবে দুদক শেষমেশ কী করবে, সেটি এখনও বোঝা যাচ্ছে না।

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তারা বিষয়টির দিকে নজর রাখছে।

চেয়ারম্যানের সাথে বসে কমিশনাররা খুব শিগগিরই এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করবেন বলেও জানানো হয়েছে।

যদিও এর আগেও অভিযোগের ভিত্তিতে সাবেক আরেক আইজিপি নূর মোহাম্মদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে তদন্ত শুরু করেছিলো দুদক।

২০১২ সালে শুরু হওয়া ওই তদন্তে অবশ্য তারা তেমন কিছুই খুঁজে পায়নি বলে জানানো হয়েছে। পরে মোহাম্মদ ২০১৮ সালের নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-২ আসন থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement