৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভদ্রলোকের খেলার বড় বিজ্ঞাপন হাশিম আমলা

হাশিম আমলা - ছবি - ইন্টারনেট

ক্রিকেট যদি হয় ভদ্রলোকের খেলা, তবে তার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হতে পারেন হাশিম আমলা। বছরের পর বছর উইলো হাতে ক্রিকেটবিশ্ব শাসন করেও বড্ড সাধাসিধে তিনি। যাকে ছুঁতে পারেনি কোন তিক্ত বিতর্ক। বরং হয়ে উঠেছিলেন সতীর্থ থেকে সমর্থক, সকলের অনুপ্রেরণার উৎস।

পৃথিবীতে যে মানুষগুলো আপনাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেন, তাদেরই একজন হাশিম আমলা। ক্রিকেটার পরিচয় ছাপিয়ে যিনি একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ। যিনি ইসলামকে হৃদয়ে ধারণ করে হয়ে উঠেছেন নিখাদ ভদ্রলোক। যার পরিধি বাইশগজের গণ্ডিতে আর বাঁধা নেই।

যা মোটেও সহজ ছিল না আমলার জন্য। অনেক বাধা বিপত্তি পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে, পাড়ি দিতে হয়েছে দূর্গম সব পথ। মুসলিম ক্রিকেটার হিসেবে শুনতে হয়েছে কখনো কটু কথাও! কিন্তু তিনি তার মতো, কখনোই পাত্তা দেননি পিছু কথাকে। করেননি প্রতিবাদ, বরং সফলতাকেই করেছেন প্রতিশোধের হাতিয়ার।

ধারাভাষ্যকার ডিন জোন্স যখন, তাকে 'সন্ত্রাসী' বলে অপমান করেন। তখনো তিনি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। উদারতার উপমা সৃষ্টি করে বলেছিলেন, ‘আমি মুসলিম। একজন মুসলিমের কাজ কেউ ক্ষমা চাইলে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া।’

বাইশগজে থেকেও যে ইসলাম ধারণ করা যায়, ধর্ম পালন করা যায় তারও উদাহরণ ছিলেন আমলা। ২০১২ সালে এক রমজানে রোজা রেখে একাই খেলেছিলেন ৫২৯ বল বা ৮৮ ওভার! যে ম্যাচে গড়েছিলেন একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে ট্রিপল শতকের কীর্তি।

সুদূর ইংল্যান্ড থেকে মইন আলির কিংবা পাকিস্তানের বিখ্যাত আম্পায়ার আলিম দারের ধর্ম পালনে বড় অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেন তিনি। ছিলেন সতীর্থের কাছেও অনুপ্রেরণার উৎস। সতীর্থ ডেল স্টেইন তাকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার যখন অনুপ্রেরণার দরকার হয়, তখন আমি আমার পাশে ঘুরে তাকাই; আর দেখি হাশিম আমলা কোরআন পড়ছেন।’

ক্রিকেটে গল্প আজ দূরে থাকুক, ক্রিকেটের বাইরে আমলাকে নিয়ে অনুপ্রেরণার আরো অনেক গল্প আছে। যা শুনতে পারেন দক্ষিণ আফ্রিকা দলের পারফরম্যান্স বিশ্লেষক প্রসন্ন আগোরামের থেকে। আমলার বিদায়ের দিমে ‘রংধনুর দেশ তার রঙ হারালো’ শিরোনামে আগোরাম লিখেছিলেন- হাশিম আমলা তার ঘরের মাঠ ডারবানে অবসর নিচ্ছেন। হাত তুলে জবাব দিচ্ছে দর্শক অভিবাদনের। আধিখ্যেতা দেখিয়ে, ‘এই সম্মানটুকু আপনার প্রাপ্য’—বলতেই বুঝলাম তাকে আরো ভালো করে জানা-বুঝা উচিত ছিল, কারণ জবাব এলো- ‘আপনাকে আগেও তো বলেছি, জীবনে প্রাপ্য বলে কিছু নেই। আমি যথেষ্ট পেয়েছি, ১০০ টেস্ট খেলে ফেলেছি। তাছাড়া, বিশ্বকাপ শেষে থেমে যাওয়াটাও খুব ভালো, তরুণেরা সুযোগ পাবে। বিদায় সংবর্ধনা পেতে ঝুলে থাকলে নিজের কাছেই নিজের সম্মান থাকবে না। এটা দল কিংবা দেশের স্বার্থের সাথে যায় না। আর সৃষ্টিকর্তা আমাকে যা দিয়েছেন তা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ।’

তার ঘরে রাতের খাবার খেয়েছিলাম। খাওয়া শেষে ভাবছিলাম প্লেটটা কোথায় রাখব। হাশিম আমলা হঠাৎ আমার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে নিলেন, খাবারের উচ্ছিষ্ট নিজ হাতে ময়লা রাখার ঝুড়িতে ফেলে প্লেটটা রাখলেন বেসিনে। ঘটনার আকস্মিকতায় অস্ফুট স্বরে প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু বলতে যাবো, তার আগেই সে বলে উঠলো, ‘আরে ভাই, আপনি আমার ঘরে এসেছেন। আপনি আমার ভাই। কিছু ক্ষেত্রে আমার ওস্তাদও। আপনাকে সম্মান করার সুযোগটুকু দিন।’

আগোরাম বলছিলেন, আমি অতটা খেতে পারি না, আর সেদিন প্লেটের খাবারো শেষ করতে পারিনি। উঠে দাঁড়াব, এমন সময় সে বলল, ‘ভাই, খাবার নষ্ট করবেন না।’ এরপর সে আমার প্লেটে খাবারের অবশিষ্ট অংশ নিজের প্লেটে নিয়ে খেতে শুরু করল। আমি আবারো হতবাক, সেদিন বুঝেছি ভালো মানুষ হয়ে উঠতে জীবনে কী কী পরিবর্তন দরকার।

২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে ১৯৬ রানে আউট হওয়ায়, দুঃখ প্রকাশ করতে তাকে বললাম, ‘ভাই, আপনার ডাবল সেঞ্চুরি পাওনা ছিল।’ আমি এ কথা বলার পর জানেন তার কি উত্তর ছিলো? ‘একটা কথা মনে রাখবেন, জীবনে কখনো কিছু পাওনা থাকে না। পুরোটাই সৃষ্টিকর্তার কৃপা। মনে আছে, আমি ৪ রানে থাকতে একটি ডেলিভারি ব্যাটের কানায় লেগে স্টাম্পের খুব কাছ ঘেঁষে চলে গেছে। ওটা বোল্ড হওয়া উচিত ছিল, ডেলিভারিটা ছিল দারুণ। অস্ট্রেলিয়ানদের উইকেটটা পাওনা ছিল। ওরা হয়তো ড্রেসিং রুমে আলোচনা করছে। আমি কত ভাগ্যবান! আরো ১৯২ রান করেছি, যা পাওনা ছিল এটা তার চেয়েও বেশি। এ কারণে আমি যে রান করেছি তা নিয়েই কৃতজ্ঞ। সব সময় সন্তুষ্ট থাকুন।’

সেটা ছিলো ২০১৫ সাল, বেঙ্গালুরুতে ঝুম বৃষ্টিতে ভেসে গেছে টেস্টের চারটা দিন। হঠাৎ একদিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ইমরান তাহির ও এক নিরাপত্তাকর্মী নিয়ে বাসার দরজায় হাজির হাশিম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ঘরে পর্যাপ্ত বসার জায়গাও ছিল না। কিন্তু হাশিম ভেতরে ঢুকে সোজা মেঝেতে বসে পড়ল। তাকে মানা করতেই বলল, ‘আপনার ঘরের মাপ নিতে এখানে আসিনি। ভালোবাসা থেকে এসেছি। আপনি আমার ভাই। দয়া করে এক পেয়ালা মসলা চা দিন।’ সে এটা খুব পছন্দ করে এবং আরেক পেয়ালা চাইল!

২০১০ সালের একটি স্মৃতি। সে বছর তার সাথে প্রথম দেখা হয়। ভারত তখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করছে। হাশিম এসে বলল, ‘একটু সাহায্য করতে পারেন?’ আমি বললাম, আপনি জীবনের সেরা ফর্মে, কী আর সাহায্য করতে পারি? ‘না, না, আমি সিরিয়াস। কেউই নিখুঁত নয়। সবশেষ সিরিজে আপনার বিশ্লেষণ আমার ভালো লেগেছে। আমি আরো শিখতে চাই, বেড়ে উঠতে চাই। খেলাটা তো যে কারো চেয়ে বড়। কেউ সব শিখতে পারে না। পেসারদের ভালো খেলছি। কিন্তু হরভজন সিংকে সামলাব কীভাবে? সে তো এই উইকেটে বাউন্স পাবে।’

দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেলে প্রায় প্রতি রাতেই সে আমার কামরায় এসে চা খেতো, ক্রিকেট কিংবা যা ভাবছে তা নিয়ে আলাপ হতো। কখনো আমার পছন্দের ভাত ও রুটি খেতে পারছি না বুঝতে পারলে আমাকে সে তার বন্ধুর বাসায় নিয়ে গিয়ে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করতো।

আমলার প্রতি আগোরামের নিজের মূল্যায়ন ছিলো এমন যে সে আসলেই ভিন্ন এক মানুষ। যদি কখনো বলি ভালো খেলেছো কিংবা অসাধারণ ব্যাট করেছো, সে বলবে, ‘সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’ কিংবা প্রসঙ্গ পাল্টে বলবে, ‘আমার ইনিংসের চেয়ে ডেল স্টেইনের ৩ উইকেট অনেক মূল্যবান ছিল।’

আমি যেমন কখনো তাকে রাগতে দেখিনি, তেমনি গর্ব করতেও দেখিনি। এমনকি খুব ব্যক্তিগত পরিবেশেও নয়। কারণ সে অভিনেতা নয়, সে এমনই; হাশিম আমলা একজনই। আমার সন্তান তার ব্যক্তিত্বের ৫০ শতাংশ পেলেও গর্ব লাগবে। নিজেকে একজন গর্বিত বাবা বলেই মনে করব। তার মতো এতটা বিনয়ী, নিঃস্বার্থ ও মাটির মানুষ আর কাউকে দেখিনি।

হাশিম আমলার জন্ম ১৯৮৩ সালে ৩১ মার্চ; দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরে। ভারতীয় গুজরাটি মুসলিম বংশের সন্তান আমলা, যা ফুঁটে উঠে আমলার আমলাতন্ত্রে।

শুভ জন্মদিন।


আরো সংবাদ



premium cement