০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মধুপুরে স্ক্যামিং ব্যবসার টাকায় মাদকের ভয়াবহ বিস্তার

মধুপুরে স্ক্যামিং ব্যবসার টাকায় গড়ে ওঠা একটি রাজকীয় ভবন : নয়া দিগন্ত -

ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে টাঙ্গাইলে অনলাইন স্ক্যামিং ব্যবসার ব্যাপক বিস্তার ঘটছে। বিশেষ করে মধুপুর উপজেলাটি এখন স্ক্যামারদের ‘স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত হয়েছে। স্ক্যামিং ব্যবসা নিয়ে তেমন আপত্তি না থাকলেও সমস্যা দেখা দিয়েছে অন্য জায়গায়। অবৈধ স্ক্যামিংয়ের মাধ্যমে অর্জিত কাঁচা টাকা দেশের তরুণদের বিপথে পরিচালিত করছে। ফলশ্রুতিতে ভয়াবহ মাদকের বিস্তার ঘটছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে না গিয়ে স্ক্যামিংয়ে জড়িয়ে পড়ছে। তৈরি হচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। এসব সামলাতে স্থানীয় প্রশাসনও রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।
অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে দেশে যেমন রেমিট্যান্স আসে- তেমনি লাখো যুবকের কর্মসংস্থানও হয়। তাই সরকার এ বৈধ পেশাকে নানাভাবে উৎসাহিত করে থাকে। কিন্তু স্ক্যামিং অনলাইনে একটি প্রতারণামূলক নিষিদ্ধ (অবৈধ) ব্যবসা। টিনএজার পর্নো, অ্যাডাল্ট সাইট ও ডেটিং সাইট নিয়ে স্ক্যামাররা কাজ করে থাকে। এটা এক ধরনের অন্ধকার জগতের ব্যবসা। এ পেশায় যৌনতা নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়।
স্থানীয়ভাবে স্ক্যামারদের নেট ব্যবসায়ী বলা হয়। দুই বছর আগে যারা রিকশা চালাতেন, ইটভাটায় কাজ করতেন, তারা এখন নিজেদের বহুতল ভবনে বসবাস করেন। দামি গাড়িতে চড়েন। অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শোরুম ও কল কারখানা গড়ে তুলেছেন।
একাধিক আইটি বিশেষজ্ঞের মতে, স্ক্যামাররা সাধারণত আমেরিকান মডেল, পর্নোস্টার বা এসকর্টদের নগ্ন ছবি, ভিডিও বা নানা তথ্য ওয়েবসাইট থেকে কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে অ্যাডাল্ট ডেটিং সাইটে আইপি হাইড করে পোস্ট দেয়। এরপর ‘টেক্সট নাউ’ নামের ভার্চুয়াল নম্বর সার্ভিসের মাধ্যমে স্ক্যামাররা এসকর্ট সেজে হাজির হয়।
যাদের এসকর্ট সার্ভিস দরকার সেই গ্রাহকরা নক করলে এসকর্ট সাজা স্ক্যামাররা ব্যক্তিগত সময় কাটানোর জন্য গ্রাহকের সাথে ডলার নিয়ে দর কষাকষি করে। নগ্ন ছবি ও ভিডিও শেয়ারের পরও অনেক গ্রাহক ভিডিও বা ভয়েস কলে রিয়েল পারসন ভেরিফাই করতে চায়। তখন রোবট সফটওয়্যার দিয়ে ভয়েস বা ভিডিও কল ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে গ্রাহকদের সন্তুষ্ট করা হয়। এতেও সন্তুষ্ট না হলে স্ক্যামাররা ভাড়াটে নারীদেরকে হাজির করে। এসব নারী স্বল্প আলোতে ন্যুড হয়ে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করে। এরপর গ্রাহকের কাছ থেকে অ্যাডভান্স হিসেবে কিছু ডলার হাতিয়ে নিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অর্জিত ওই ডলার স্ক্যামাররা বিভিন্ন ক্যাশ অ্যাপ, কার্ড বা বিট কয়েনের মাধ্যমে রিসিভ করে। এরপর বিশেষ কায়দায় ডিজিটাল পেমেন্ট সার্ভিসের অ্যাকাউন্ট খুলে ডলারগুলো বিট কয়েনে কনভার্ট করে বাংলাদেশী টাকায় রূপান্তর করে নেয়।
মধুপুর উপজেলায় প্রায় পাঁচ হাজার কিশোর ও তরুণ এই নিষিদ্ধ অনলাইন স্ক্যামিংয়ে জড়িত। সাইবার অপরাধের মাধ্যমে ডলার কামানোর ধান্ধায় এখন স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা, এমনকি গৃহবধূরাও (বিশেষ করে প্রবাসীদের স্ত্রীরা) এতে যুক্ত হচ্ছেন। এই স্ক্যামিং যেমন নব্য ধনকুবের তৈরি করছে- তেমনি মাদক ও জুয়াসহ সামাজিক নানা ব্যাধি ও সমাজে নৈতিক অবক্ষয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
রনি সরকার নামে এক স্ক্যামার জানান, ডেটিং স্ক্যাম ছাড়াও স্ক্যামাররা আমেরিকায় সম্পত্তি কেনা-বেচা, বাড়ি ভাড়া বা রিয়েল এস্টেট সাইটে গিয়ে ক্রেগলিস্ট অর্গানাইজেশনের আইপি হাইড করে লোভনীয় তথ্য সংযুক্ত করে বিজ্ঞাপন দেয়। উপযুক্ত গ্রাহক পেলে একই কায়দায় অ্যাডভান্স ডলার নিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। আমেরিকার জনপ্রিয় ক্লাসিফায়েড সাইট ব্যাকপেইজ ডটকমের আদলে মধুপুরের স্ক্যামাররা নিজেরাই ক্লাসিফায়েড ডেটিং সাইট তৈরি করে প্রতারণামূলকভাবে লাখ লাখ ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। রনি সরকার জানান, টু ব্যাকপেইজ ডটকম, ব্যাকলিস্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং স্কিপ দ্য গেইমস ডটকম নামের সাইটগুলোর মালিক মধুপুরের কয়েকজন স্ক্যামার। তারা এখন শত কোটি টাকার মালিক।
মধুপুরের ফ্রিল্যান্সার ও ওয়েব ডেভেলপার সবুজ মিয়া জানান, তার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা ফাইভার থেকে ভালো আয় করছিলেন তারাও এখন স্ক্যামিং ব্যবসায় চলে যাওয়ায় তার বৈধ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেছে। মধুপুরের নকরেক আইটির মালিক সুবীর নকরেক জানান, ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে যেখানে বৈধ পথে প্রচুর অর্থ আয় করা যায়, সেখানে স্ক্যামিংয়ের মতো প্রতারণামূলক কাজের সাথে জড়িত হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এতে দেশের ইমেজ নষ্ট হয়।
শোলাকুড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইয়াকুব আলী জানান, অনলাইন স্ক্যামিংয়ের টাকা এখন হাওয়ায় উড়ছে। স্ক্যামিংয়ের মাধ্যমে এক শ্রেণীর কিশোর ও যুবকের হাতে অঢেল অর্থ চলে আসায় তারা মাদক ও জুয়াসহ নানা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এতে সমাজে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে।
মধুপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মুরাদ হোসেন জানান, অল্প সময়ে অধিক টাকার নেশায় মধুপুরে স্ক্যামারদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড বন্ধে পুলিশ সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে।
মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শামীমা ইয়াসমিন পরিস্থিতির সত্যতা স্বীকার করে জানান, অবৈধ স্ক্যামিংয়ে অর্জিত কাঁচা টাকা তরুণদের মাঝে মাদকের প্রসার ঘটাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে না গিয়ে এই প্রতারণামূলক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ছয়জন স্ক্যামারকে আটক করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। কিছু ভবন সিলগালা ও স্ক্যামারদের যেন বাড়ি ভাড়া দেয়া না হয়- সেজন্য অনেক ভবন মালিককে সতর্ক করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement