২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কালের সাক্ষী মুরাদনগরের জমিদার বাড়িগুলো সংরক্ষণের দাবি

জাহাপুর গৌরীমোহন জমিদার বাড়ি -

সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে জমিদারদের ঐতিহ্য। বিলুপ্ত হয়ে গেছে জমিদারি প্রথাও। শুধু কালের পাতায় সাক্ষী হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে তাদের স্মৃতিবিজড়িত পুরাকীর্তি। যুগের পর যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার অনন্য নিদর্শন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বিভিন্ন জমিদার বাড়ি।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িগুলো আগের জৌলুসপূর্ণ দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে মুরাদনগর। এখানেই বাড়িগুলো অবস্থিত। বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসাহী লোকজন আসেন দেখতে। এখান থেকেই আদায় হতো খাজনা। তার জন্য ব্যবহার হতো ‘গয়না’ নৌকা। প্রজারা খাজনা হিসেবে দিতেন শস্য। আদায় করা খাজনা রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারে জমা দেয়ার জন্য চৈত্র মাসের শেষ দিন সূর্র্যাস্তের (সূর্র্যাস্ত আইন) আগেই জমিদাররা কুমিল্লা যেতেন।
জাহাপুর গৌরিমোহনের জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬২ সালে। তবে জমিদার বাড়ির বংশধররা প্রায় ৪০০ বছর আগেই এখানে বসতি স্থাপন করেন। জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা গৌরি মোহন। তাকে এই জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করার জন্য সাহায্য করেছেন তার ভাই রাম দয়াল ও কমলা কান্ত। জমিদার বাড়ি এবং জমিদার বাড়ির ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাবপত্র এখনো টিকে আছে। তাদের এগারতম বংশধররা এখনো ধ্বংস প্রায় বাড়িতে বসবাস করছেন।
বাড়ির প্রবেশ পথে রয়েছে মুখোমুখি দু’টি সিংহ। রয়েছে অনেক বড় একটি জগন্নাথ মন্দির। এ ছাড়াও বাড়ির চারদিকে জমিদারদের ব্যবহারিক অনেক জিনিসপত্র ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে ।
উপজেলার বাঙ্গরাবাজার থানা সদরে রয়েছে রূপবাবুর জমিদার বাড়ি। প্রায় ২৫০ বছর আগে ৯টি গ্রামজুড়ে ছিল রূপবাবুর জমিদারি। জমিদার রূপবাবুর বাবা উমালোচন মজুমদার ছিলেন প্রজাবান্ধব। ১৮৮৫ সালে বাঙ্গরায় একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন উমালোচন। ১৯০০ সালে প্রজাদের চিকিৎসার জন্য রূপবাবুর মা শান্ত মনি দেবীর নামে অসাধারণ নকশায় একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ও স্থাপন করেন, যা বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে ধ্বংসপ্রায়। এ ছাড়াও বাঙ্গরাবাজার, জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলো রূপ বাবুদের দেয়া। বাঙ্গরা বাজারে অগ্রণী ব্যাংক শাখাও রূপ বাবুদের নামে।
উপজেলার মেটংঘরে দারিকসাহা জমিদার বাড়ি। জমিদারদের উত্তরসূরি দয়ালসাহ (৮১) ঢাকায় বসবাস করেন। কথা হলে তিনি জানান, তার বাবা দারিকসাহা ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারী লাভ করেন। আইয়ুব খানের আমলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত জমিদারি বিদ্যমান ছিল। তিনি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর গ্রামের জায়গা-জমি বিক্রি করে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে যান। বর্তমানে জমিদার বাড়ির সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি শ্রীমতি চম্পক লতা রায় (৯৫)। কথা হলে তিনি বলেন, তার দাদাশ্বশুর দারিকসাহা ছিলেন বড় জমিদার। সবাই তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।
উপজেলার রহিমপুর মনমোহন পোদ্দার জমিদার বাড়ি আরেক ঐতিহ্য। পুরনো স্থাপনা আর ইটের কারুকাজ দেখলেই আঁচ করা যায় তাদের সেই গৌরবময় দিনগুলোর কথা। প্রবেশ করে দেখা হয় বাড়ির বর্তমান কর্তা পিংকো পোদ্দারের সাথে। তিনি জানান, তাদের এ বাড়িগুলোর বয়স অন্তত ১১৫-১২০ বছর। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পর থেকে ঘরগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। তার দাদামহ এ বংশের জমিদার ছিলেন।
উপজেলার থোল্লার মীর আশরাফ আলী জমিদার বাড়ি বহন করছে অনেক ঐতিহ্য। থোল্লার জমিদার মীর আশরাফ আলী খানের বাসভবন ছিল বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট এলাকাজুড়ে। থোল্লার প্রভাবশালী জমিদার মীর আশরাফ আলী খান (১৭৫৫-১৮২৯) ঢাকার মানুষ ছিলেন। জমিদারির সদর দফতর থোল্লার পোশাকি নাম এখন বাখরনগর। সম্রাট শাহ আলমের ছেলে নবাব সৈয়দ করিম কুলি খানের বংশধর ছিলেন তিনি। তার আগে আগা বাকের এই জমিদারি পেয়েছিলেন ঈসা খাঁর বংশধর কিশোরগঞ্জের হায়বত খানের মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার সুবাদে। শের শাহের আমলে পরগণার নাম দেয়া হয় বলদাখাল। ১৯১০ সালের গেজেটে নাম হয় বরদাখাত।
এ ছাড়াও কামাল্লা জমিদার, মধ্যেনগর দুর্গারাম লুথ জমিদার, ছালিয়াকান্দি জমিদার, উপজেলা সদরের মহিনসা জমিদার বাড়িও রয়েছে। তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না।
মুরাদনগর উপজেলার বিশিষ্টজনদের সাথে কথা হলে তারা জানান, মুরাদনগরের পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িগুলো যদি শিগগিরই সরকারিভাবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ না নিলে কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাবে সেই সব স্মৃতি। তারা চান জমিদার বাড়িগুলো সংরক্ষণ করে আগামী প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে।
মুরাদনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আহসানুল আলম সরকার কিশোর বলেন, মুরাদনগরের জমিদার বাড়িগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। শিগগিরই বাড়িগুলোকে সরকারিভাবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement