২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বড় কষ্টে শ্রমজীবী মানুষ

তাহিরপুরে পীরশহরে যাত্রী না থাকায় স্থানীয় যান চালকরা বেকার সময় কাটাচ্ছেন : নয়া দিগন্ত -

ভয়াবহ করোনা দুর্যোগে দেশব্যাপী সব কিছু বন্ধ থাকায় বড়ই দুর্দিন চলছে শ্রমজীবী মানুষের। আয় রোজগার বন্ধ থাকায় তাদের পরিবারের দিন চলছে খেয়ে না খেয়ে। শ্রমজীবী মানুষের জীবনের চাকা বন্ধ করে দিয়েছে এই করোনা। নিষেধাজ্ঞা কত দিনে শেষ হবে সে দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে আছেন তারা। আর নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও সব কিছু আগের মতো স্বাভাবিক হবে কি না সে চিন্তাও আছে। এক কথায় শ্রমজীবী ও নি¤œ আয়ের মানুষ এখন বড়ই অসহায়। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও লালমনিরহাটের পাটগ্রামের অসহায় শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশার কথা জানিয়েছেন আমাদের সংবাদদাতারা।
তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, করোনার কারণে দেশব্যাপী নিষেধাজ্ঞার কারণে আয়-রোজগার বন্ধ শ্রমজীবী ও নি¤œ আয়ের মানুরেল। তাদের পরিবারের দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। ঘরে হাওরবেষ্টিত জেলার তাহিরপুর উপজেলার খেটেখাওয়া দিনমজুর মানুষ এখন তাকিয়ে আছে কবে করোনার নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে, কবে তাদের আয়ের চাকা সচল হবে। তাহিরপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় সড়কে মাঝে মধ্যে দু-একটা রিকশা, টমটম ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে। এ ছাড়া সব কিছু বন্ধ। তাহিরপুর বাজারে কথা আলী আহমদ নামে এক রিকশাচালকের সাথে। তিনি বলেন, ‘পেট-পিঠের তো লকডাউন হয় না। রিকশা না চালালে খাবো কী? বউ-বাচ্চা তো না খেয়ে মরবে। মুখোশ (মাস্ক) আর হাত ধোয়ার ওষুধ ছাড়া আর পেটে দেয়ার মতো খাবার তো কেউ দেয় না। তা হলে কিভাবে সংসার চলবে। আর বের হয়েও এখন মানুষ পাচ্ছি না। সারা দিনে আগে কম হলেও ৫০০ টাকার বেশি উপার্জন করছে পারতাম এখন তো ১০০ টাকা পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে।’
বাদাঘাট বাজারের টমটম চালক এরশাদ মিয়া ও মনিরুল ইসলাম টমটম জানান, সারাদেশে লকডাউন চললেও অসহায় ও দিনমজুরদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও খাদ্য দিয়ে সহযোগিতা করেনি। এ অবস্থায় দিনমজুর শ্রেণীর লোকজন করোনা হওয়ার আগেই না খেয়ে মরবে। শুনছি সরকারি কিছু ত্রাণ দিয়েছে তারা তো পাননি।
মোটরসাইকেলচালক নানু মিয়া বলেন, ‘ভাই আগের মতো এখন তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ যাওয়ার মানুষ পাই না। বড় কষ্টের মাঝে দিন পার করছি।’ সিএনজিচালক মাসুক মিয়া জানান, এখন সিএনজি নিয়ে কোথাও যাওয়া যায় না, সব বন্ধ করে দিয়েছে। কয়েক দিন ধরে ঘরেই বসে আছি। সংসার চলবে কিভাবে বুঝতে পারছি না। কবে এই ভাইরাসের ঝামেলা শেষ হবে আল্লাহ ভালো জানেন।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল জানান, উপজেলা সদর ইউনিয়ন ও শ্রীপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের অতিদরিদ্র কর্মহীন মানুষের মাঝে চাল, মসুর ডাল বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও উপজেলায় এক হাজার পরিবারের মধ্যে সহায়তা দেয়া হবে। শনিবার প্রথম দিন ১৪০টি পরিবারের মধ্যে সহায়তা দেয়া হয়েছে। উপজেলার বাকি ইউনিয়নগুলোতে এ কার্যক্রম চালু হবে।
পাটগ্রাম (লালমনিরহাট) সংবাদদাতা জানান, ‘কেমন করি যে চইলমো, ছাওয়া ছোটক (ছেলে-মেয়ে) কি খাওয়ামো কোনো দিশা পাইছে না, এক ঘণ্টা থাকি বসি আছি, একটা যাত্রী পাই নাই।’ কথাগুলো বলছিলেন পাটগ্রাম পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রিকশাচালক সায়েদুল ইসলাম। উপজেলা শহরের চৌরাস্তা মোড়ে যাত্রী খোঁজে রিকশা নিয়ে সায়েদুলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি এভাবে তার দুঃখের কথা শোনান।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে উপজেলা প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেয়ায় কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া পৌর শহরের সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। কলকারখানা ও বাস-ট্রাকসহ যানবাহন বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে পড়েছে শত শত শ্রমিক। এসব শ্রমিক এখন কী করবে, কোথায় যাবে, তাদের পরিবার কিভাবে চলবে সেই চিন্তায় দিশেহারা। করোনাভাইরাস তাদের সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। পাটগ্রাম উপজেলায় কয়েক হাজার রিকশাভ্যান, সিএনজি অটোরিকশা, মাইক্রো বাস চলাচল করে। এসব যাবাহনের মধ্যে কিছুসংখ্যক চলাচল করলেও বেশির ভাগ বন্ধ। বুড়িমারী স্থলবন্দরে হাজার হাজার শ্রমিক ট্রাক লোড-আনলোড ও পাথরভাঙার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এসব কিছুই এখন বন্ধ। ফলে এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরাও কাজ না থাকায় এখন বেকার।
বুড়িমারী স্থলবন্দরের শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি সফর আলী বলেন, আমার সংগঠনে দুই হাজার ৬০০ শ্রমিক কাজ করেন। লোড-আনলোড বন্ধ থাকায় এসব শ্রমিক এখন বেকার। এ ছাড়াও পাথরভাঙার সাথে সংশ্লিষ্ট আছে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক, তারাও বেকার।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সরকার এই সংক্রমণ যাতে দেশব্যাপী ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেয়। সরকারের এ পদক্ষেপের অংশ হিসেবে উপজেলা প্রশাসন সচেতনামূলক প্রচারণার পাশাপাশি পৌর শহরে জীবানুনাশক ওষুধ ছিটানো শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, দোকানে দোকানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বৃত্ত এঁকে দেয়া হয়েছে। এই দূরত্ব বজায় না রাখায় কারো কারো জরিমানাও হয়েছে। ওষুধ ও নিত্যপণ্যের দোকান ছাড়া সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় শ্যালো পার্টসের দোকান। এতে বিপাকে পড়েন ইরি-বোরো ও ভুট্টাচাষিরা। এখন ইরি-বোরোর ভরা মৌসুম চলছে। কৃষকরা জমিতে সেচ দেয় শ্যালোচালিত মেশিন দিয়ে। এসব মেশিন নষ্ট হলে খুচরা যন্ত্রাংশর প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাজারে পার্টসের দোকান বন্ধ থাকায় তারা দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল গাফফার বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা আছে চলমান বোরো মৌসুমের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ, ব্যবসার সাথে জড়িতদের পণ্য পরিবহন ও ক্রয়-বিক্রয় জরুরি বিবেচনায় যথারীতি অব্যাহত থাকবে। সার, বালাইনাশক, সেচের জন্য জ্বালানির কেনা-বেচা সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত চলমান থাকবে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব পার্টসের দোকান আছে তারা সীমিত পরিসরে দোকান খুলবে। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement