০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অস্ট্রেলিয়ান টিভি উপস্থাপককে কেন আটক করেছে চীন?

সিসিটিভি ইংরেজি ভাষার চ্যানেলে কাজ করতেন চেঙ্গ লেই - ছবি - বিবিসি

চীনের রাষ্ট্রীয় ইংরেজি সংবাদ মাধ্যমের প্রধান মুখ হিসেবে কাজ করতেন চেঙ্গ লেই, যেখানে তিনি কঠোর নিয়ন্ত্রণে লেখা ‘চীনের গল্প’ উপস্থাপনা করতেন। অনুষ্ঠানটির লাখ লাখ দর্শক রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক এই বাণিজ্য বিষয়ক সাংবাদিক বেইজিংয়ে সিজিটিএন (চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক)-এ কাজ করতেন। তবে তার শুরুটা হয়েছিল হালকা ধাঁচের রান্নার একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।

তবে গত মাসে চেঙ্গ হঠাৎ করেই দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যান। বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সিজিটিএন ওয়েবসাইট থেকে তার প্রোফাইল এবং ইন্টারভিউগুলো সরিয়ে ফেলা হয়।

সোমবার অস্ট্রেলিয়ার সরকার জানায়, ৪৫ বছর বয়সী এই সাংবাদিককে আটক করেছে চীনের কর্তৃপক্ষ এবং অজ্ঞাত একটি স্থানে নজরবন্দি করে রেখেছে।

তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয়নি এবং আটকের কারণও জানা যায়নি বলে অস্ট্রেলিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ভিডিও লিংকের মাধ্যমে গত সপ্তাহে মিজ চেঙ্গের সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন কূটনীতিকরা।

তবে তার আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার চীনের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র হুয়া চুনিং সাংবাদিকদের বলেন, তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে পারছেন না, তবে চীন আইন অনুযায়ীই সব কিছু করছে।

কিন্তু এই অস্ট্রেলিয়ান নাগরিককে আটকের বিষয়টি একটি সতর্কবার্তাও দিচ্ছে। তার জাতীয়তাবাদের কারণে ধারণা করা হচ্ছে যে, অস্ট্রেলিয়া ও চীনের মধ্যকার কূটনৈতিক উত্তেজনার কারণে এই আটকের ঘটনা ঘটতে পারে।

সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিশ্লেষণ
বিশ্লেষকরা বলেন, রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমের একজন উপস্থাপক হিসাবে চেঙ্গ সীমানা বুঝে চলায় অভ্যস্ত ছিলেন। ব্যবসায়িক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করার সময় তিনি বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির প্রধানদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। কিন্তু সেই সময়েও তিনি অনেক সময় রাজনীতি এড়িয়ে চলতেন। তবে চীনের বড় বড় অনেক অনুষ্ঠানও তিনি কাভার করেছেন।

কিন্তু যেখানে চীনের বিরুদ্ধে তার কোনো কর্মকাণ্ডের তথ্য জানা যাচ্ছে না, সেখানে তাকে এভাবে আটক করার বিষয়টি বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের হতবাক করে দিয়েছে। চীনের আইনি ব্যবস্থা নিয়েও উদ্বেগ আছে, যেখানে কোনো অভিযোগ ছাড়াই একজনকে অনেক মাস আটকে রাখা যায়।

চীনের জন্ম হলেও ১০ বছর বয়সে পরিবারের সাথে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে চলে যান চেঙ্গ। তার বাবা সেই সময় একটি ডক্টরেট ডিগ্রি নিতে গিয়েছিলেন।

সেখানেই তিনি অস্ট্রেলিয়ান ভাষা শেখেন। তার মা-বাবা এবং দুই সন্তান অস্ট্রেলিয়াতেই বসবাস করে।

‘আমি জীবনযাপন এবং স্বাধীনতার জন্য এখনো (কোন দেশ হিসাবে) অস্ট্রেলিয়াকে বেছে নেবো,’ তিনি বলেছিলেন।

মেলবোর্নে অর্থনৈতিক খাতের চাকরিতে বিরক্ত হয়ে ২০০০ সালে তিনি চীনে চলে আসেন। চীন ও ইংরেজির দক্ষতা এবং দুই দেশের সংস্কৃতি জানার বিষয়টিকে তিনি কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন।

২০০৩ সালে তিনি সিসিটিভি ইংরেজি ভাষার চ্যানেলে কাজ করতে শুরু করেন, যেখানে বেশিরভাগই ছিলেন তার মতো বিদেশ থেকে আসা।

পরবর্তীতে তিনি সিএনবিসির চীনের সংবাদদাতা হিসাবে নয় বছর কাজ করেন। এরপরে সিসিটিভি'র ইংরেজি নতুন নাম সিজিটিএন চ্যানেলে ২০১৩ সাল থেকে কাজ করতে শুরু করেন।

সূক্ষ্মদৃষ্টির গণমাধ্যম কর্মী
চ্যাঙ্গ লির দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং চীনে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক রাষ্ট্রদূত গিওফ রাবি তার সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি 'খুবই অভিজ্ঞ একজন সাংবাদিক' এবং যিনি 'অনেক দিন ধরে চীনে কাজ করেছেন'।

তিনি বিবিসিকে বলেছেন, তার প্রতিবেদনগুলো হচ্ছে 'খুবই বস্তুনিষ্ঠ' এবং রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমের ভেতরে থেকেই যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ হিসাবে তিনি কাজ করেছেন।

তিনি বলছেন, একজন পেশাদার এবং স্মার্ট ব্যক্তি হিসাবে তিনি খুব ভালো ভাবেই বুঝতেন যে তিনি কোথায় কাজ করছেন এবং খুব সতর্ক থাকতেন।

‘সুতরাং এটা বোঝা কঠিন যে, তিনি কী এমন করেছেন যার কারণে তিনি এরকম একটি সমস্যায় পড়েছেন,’ তিনি বলছেন।

গত কয়েক বছরে চীনের বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব- টেলিভিশন উপস্থাপক এবং জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেছেন অথবা তাদের নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়েছে।

তবে রাবি বলছেন, এসব কারণে কাউকে আটক করার ঘটনা 'খুব দুর্লভ' এবং এবারই প্রথম কোন বিদেশি গণমাধ্যম কর্মীকে আটক করা হলো।

‘চীনে এভাবে (কোন গণমাধ্যম কর্মীকে) আটকের ঘটনা দুর্ঘটনাবশত বা নিয়মিত ঘটনার অংশ হিসাবে হয়নি,’ বলছেন রাবি।

রাজনৈতিক গুটি?

বিশ্বে চীন যতটা নিজের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে, ততই চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠছে।

২০১৮ সালে নিরাপত্তাজনিত কারণে ফাইভ জি নেটওয়ার্কের কাজে অংশ নেয়া থেকে চীনের প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করে অস্ট্রেলিয়ার ডানপন্থী সরকার।

এই বছর সেই উত্তেজনা আরো বাড়ে। গত এপ্রিল মাসে করোনাভাইরাস মহামারির উৎপত্তি খোঁজার আহবান জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়া- যা চীনকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে বলে বেইজিং মনে করে।

বাণিজ্য দিয়ে তার পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার অভিযোগ ওঠের চীনের বিরুদ্ধে। দেশটি অস্ট্রেলিয়ার গরু, ওয়াইন এবং বার্লি আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গত বছর থেকে দ্বিপাক্ষিক সব বৈঠক থেকে অস্ট্রেলিয়াকে বাইরে রাখা হয়েছে।

তবে রাজনৈতিক এই দ্বন্দ্বের সাথে চেঙ্গ লেইকে আটকের কোনো সম্পর্ক আছে বলে মানতে চান না অস্ট্রেয়িলার কর্মকর্তারা। অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মিজ চেঙ্গকে চীন 'গুটি' হিসাবে ব্যবহার করছে বলেও অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিসে পেইনি মনে করেন না।

তিনি বলছেন, ‘আমি এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই না। এটা একেবারেই অনুমান নির্ভর একটা ব্যাপার হবে। আমাদের এখন কাজ হলো, তার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিশ্চিত করা।’

চীনে আটক হওয়া অস্ট্রেলিয়ার আরেকজন নাগরিক লে খস ইয়াঙ হেঙজুনকে নিয়ে এরমধ্যেই হিমশিম খাচ্ছেন দেশটির কূটনীতিকরা। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে তাকে আটকে রাখা হয়েছে এবং বেশ কয়েকমাস পরে তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়েছে।

তাকে অমানবিক অবস্থায় রাখা হয়েছে বলে অস্ট্রেলিয়ার কূটনীতিকরা অনেকবার অভিযোগ করেছেন।

দেশটির দু’জন নাগরিককে আটকে রাখার ঘটনা সারা বিশ্বের উদ্বেগ তৈরি করেছে।

গত বছর সাবেক কূটনীতিক মাইকেল কোভিরিগ এবং ব্যবসায়ী মাইকেল স্পাভোর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এনেছিল চীন।

সেই গ্রেফতরের সাথে কানাডায় হুয়াওয়ের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক গ্রেফতার হওয়ার সাথে সম্পর্ক থাকার অভিযোগ চীন নাকচ করে দিয়েছিল। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবেই চীন ওই পদক্ষেপ নিয়েছে।

সাংবাদিক চেঙ্গ লেইকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে, সেটা নিয়ে এখনো অনেক ধোঁয়াশা আছে। কিন্তু রাবির মতো বিশ্লেষকরা মনে করেন, তাকে গ্রেফতারের 'সময়'টা বিবেচনা থেকে বাদ দেয়া যাবে না।

‘দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়গুলো এখানে কোনো ভূমিকা রাখেনি, সেটা ভাবা ভুল হবে,’ তিনি বলছেন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement