০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিদায় সে এক চিরন্তন সত্য

বিদায় সে এক চিরন্তন সত্য -

পৃথিবী নামক গ্রহে জীবনের ব্যাপ্তি নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। তার পরও মর্তের মোহে মত্ত হয়ে স্বর্গের অফুরন্ত সুখের আশা ভুলে ভোগ বিলাসে লিপ্ত থাকা মানুষের সংখ্যাটাই যেন বেশি। জীবনের পরিব্যাপ্তি শেষে ইতি, সমাপ্তি কিংবা বিদায় যে আসবেই, চিরন্তন এই সত্যকে পাশ কাটিয়ে নশ্বর এই সমাজে আমাদের অমরত্বের ব্যর্থ প্রচেষ্টা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা। মৃত্যু যদি হয় এখানে সবচেয়ে নিঠুর বাস্তবতা, তবে ‘বিদায়’ শব্দটা রূঢ় বৈ কিছু নয়। ঠিক সময়ে হাসিমুখে বিদায় বলতে পারাটাও একটা গুণ, যে গুণ নিয়ে হয়তো সবাই জন্মায় না। তাইতো কেউ বিদায় বলে প্রকৃতির নিয়ম মেনে, কেউ বিদায় বলে বাধ্য হয়ে, কেউবা নিভৃতে হারিয়ে যায় পরিস্থিতির চাপে।
তাতে কি সত্যিই কিছু যায় আসে? বিদায়বেলা মানুষের ভালোবাসা পাওয়াটা যেমন সৌভাগ্যের, তেমনি আপনার বিদায়ে কারো হৃদয়ে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হবে, যে শূন্যতা পূরণ হবার নয়, এমনটা ভাবা বোকামি। মহাকালের অনন্ত পথে কত হাজারো কোটি অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে চোখের আড়ালেই। তবুও থেমে নেই কোনো কিছুই, হয়তো অন্তিমলগ্নের আগে থামবেও না। তার পরও বিদায় বলতেই আমাদের যত ভয়, আক্ষেপ আর পিছুটান।
গতিময় জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদেই কখনো কখনো মায়ার বাঁধন ছেড়ে চলে যেতে হয় অচেনা গন্তব্যে। বার বার পিছু ফেরা অশ্রু টলটলে চোখও যখন লক্ষ্য স্থির করে নেয়, আবেগের লাগাম টেনে ওই দূর বহুদূরের দৃষ্টিতে তখন শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়ার তাড়া।
শিক্ষা, কর্ম বা পেশাগত জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই একটা সময় আসে, যখন আপনার শরীর, বয়স, পরিপার্শ্ব বলে দেয়, এখন থামতে হবে। এই থেমে যাওয়া বা বিদায় বলে দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট স্থান, কাল, পাত্রের অপেক্ষা করা নেহাতই বোকামি। কোনো অদ্ভুত মায়ার টানে, ভালোবাসার বিমোহে বিমুগ্ধ হয়ে বিদায়কে দীর্ঘায়িত করা বরাবরই প্রকৃতির অপছন্দনীয়। কারো বোঝা হয়ে ওঠার আগেই বুঝা উচিত বিদায় নিরন্তর পথচলারই একটা ছোট্ট অংশ। আর সেই অংশে একটি ভুল সিদ্ধান্ত মুহূর্তেই এপিঠ ওপিঠ করে দিতে পারে বিগত দিনের সাফল্য ব্যর্থতার ইতিহাস।
সফলতার সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেও ঠিক সময়ে বিদায় বলতে না পারায় নিন্দনীয় হওয়ার নজির কিন্তু কম নয়। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো মহাতারকাকেও বসে থাকতে হয় সাইড বেঞ্চে, কারো চক্ষুশূল হয়ে নীরবে নিজেদের গুটিয়ে নেন মুশফিক-রিয়াদেরা।
দূর ওই আকাশের তারার মেলায় এভাবেই হারিয়ে যায় কত শত নক্ষত্র। তাই বুঝি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়’। নক্ষত্রের পতন হবে জেনেও মিছে মরীচিকার পেছনে হন্যে হয়ে ছুটে চলার মাঝেও যে থাকে অকৃত্রিম ভালোবাসা, তা উপলব্ধি করার সাধ্য কতজনেরই বা থাকে।
ছাত্রজীবনে ‘বিদায়’ শব্দটা ঘুরে ফিরে বার বার আসে। জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকা অনিবার্য এই সময়টাকে পাশ কাটিয়ে চলা অসম্ভব। স্কুলের আট-দশ বছরের সম্পর্কগুলো এক নিমিষেই শেষ করে দিতে হয় দুই বছরের কলেজ জীবনের জন্য। এর পরের সময়টা যতটা মধুর ও রোমাঞ্চকর হয়, বিদায়টাও হয় ততটাই বিষাদের, আক্ষেপের আর চ্যালেঞ্জিং।
যখন প্রতিটি প্রান্ত ছুটে বেড়ানো চিরচেনা ক্যাম্পাসে আর পড়বে না কোনো পদধূলি, একসময়ের প্রাণের মঞ্চগুলো তখন বড্ড অপরিচিত মনে হবে। ক্লাসের ফাঁকে টঙের দোকানে এক কাপ চায়ের আড্ডা, নির্ঘুম রাতে একসাথে খালি গলায় প্রাণখুলে গান গাওয়া, ঘোরাঘুরি, টিএসসিতে স্নিগ্ধ বিকেলের মুখরতা, সবই তখন সোনালি অতীত। বৃষ্টি, কুয়াশা বিলাশ, শরৎ, হেমন্ত, বসন্তে উৎসব, ঘটা করে শাড়ি-পাঞ্জাবি কিংবা ফরমাল সাজা, ছবি তোলা মুহূর্তগুলো শুধু থেকে যায় স্মৃতির পাতায়।
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গ্রাউন আর হ্যাট পরে সনদ নেয়ার মাধ্যমে শিক্ষা জীবনের একরকম বিচ্ছেদের মহরত প্রদর্শনী হয়ে যায় কারো কারো কাছে। এর পর প্রাক্তন হয়ে ছেড়ে দিতে হয় স্থান, নতুনের বরণে ব্যস্ত হয়ে যায় সবাই।
জীবনের প্রতিটি বিদায়ে নতুন করে শুরু হয় নতুন কোনো অধ্যায়। একটা গুডবাই বলে দেয়া মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়। পশ্চিমে অস্ত যাওয়া সূর্যটা ক্ষণিকের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয় আঁধার রাতের চাঁদের মুগ্ধতার কাছে। কিন্তু অন্ধকার ঠেলে আবারো দেখা দেয় পুব দিগন্তে লাল আভা ছড়িয়ে, উন্মোচিত হয় আলোর দুয়ার।
যুগে যুগে অগণিত হৃদয়গ্রাহী জীবনের উদয় থেকে অনন্তের পথে এসেছে অজস্র মর্মস্পর্শী প্রলয় শিখা। ব্যতিক্রম শুধু ধরণীর বুকে রূপকথার গল্পের এপিটাফ লেখা মহারথীদের দৃষ্টান্ত তৈরি করা মহাকাব্যের অনুরণন। তারা প্রমাণ করে গেছেন, জীবনের জন্ম হয় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য ঠিকই, কিন্তু সব চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়। সাম্রাজ্য ছেড়ে একদিন বিদায় বলতেই হবে, তবে সেই বিদায়ের সুরে শেষ বেলার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি, জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।


আরো সংবাদ



premium cement