৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অভ্যাস যায় না ধুইলে

মূল : শেখ সাদী
-

অনেক অনেক দিন আগের কথা। আরব্য এক ডাকাতদল কোনো এক পাহাড়ের চূড়ায় ঘাঁটি গেড়েছিল। কাফেলা চলাচলের রাস্তা রুদ্ধ করে। আর আশপাশ এলাকার জনগণ তাদের অত্যাচারে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। ওই দেশের সৈন্য-সামন্ত তাদের প্রতিরোধ করতে অক্ষম ছিল। কারণ ডাকাতদল পাহাড়ের চূড়ায় এক গুহায় শক্তিশালী বেষ্টনীযুক্ত নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানিয়ে নিয়েছিল। ঘটনাক্রমে দেশের জ্ঞানী গুণী বুদ্ধিজীবীরা তাদের প্রতিহত করার ব্যাপারে পরামর্শ করলেন যে, যদি এই দস্যুদলকে আর কিছু দিন এভাবে চলতে দেয়া হয় তাহলে পরবর্তীতে তাদের প্রতিহত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই সবাই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, একজন গুপ্তচরকে তাদের গতিবিধি অনুসন্ধানে নিযুক্ত করা হবে এবং অন্য সৈন্যরা সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। এমনিভাবে কিছু দিন যাওয়ার পর দস্যুদল পাহাড়ের পাশে কোনো এক সম্প্রদায়ের ওপরে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে গুহা থেকে বের হয়ে পড়ল এবং তাদের গুহা তখন শূন্য ছিল। আর এ দিকে ওই গুপ্তচরের পাঠানো খবরের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবীরা কয়েকজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক পাঠালেন। যাতে করে তারা ডাকাতদলের আস্তানায় লুকিয়ে থাকে এবং সুযোগ মতো পদক্ষেপ নিতে পারে। গভীর রজনীতে দস্যুদল যখন লুণ্ঠনকৃত মালামাল নিয়ে ফিরে এলো, শরীর থেকে অস্ত্রশস্ত্র খুলে রেখে দিলো, তখন তাদেরকে প্রথম যে শত্রু আক্রমণ করল তা ছিল নিদ্রা। অর্থাৎ তারা ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের এক প্রহর যখন অতিবাহিত হলো তখন তারা ছিল গভীর ঘুমে মগ্ন। আর এই সুযোগে ওঁৎ পেতে থাকা নির্ভীক সৈন্যরা গোপনস্থল থেকে বের হয়ে দস্যুদলের প্রত্যেক সদস্যকে বেঁধে ফেলল এবং যখন সকাল হলো তখন প্রত্যেককে রাজ দরবারে উপস্থিত করা হলো। বাদশাহ প্রত্যেককে হত্যা করার আদেশ দিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে এমন একজন বালক ছিল। যে এখনো যৌবনের ফল ভোগ করেনি তথা পরিপূর্ণভাবে যৌবনে উপনীত হয়নি। আর তার চেহারায় কেবল কিছু দাড়ি গজিয়েছিল। রাজদরবারের জনৈক মন্ত্রী তার ব্যাপারে বাদশাহর কাছে সুপারিশ করে বলল, এই বালক এখনো জীবন গাছের ফল ভক্ষণ করেনি। এ জন্য আপনার নেক মর্জি হয় যে, আপনি তাকে হত্যা করার থেকে মুক্ত করবেন। বাদশাহ মন্ত্রীর এই কথা শোনার সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন এবং বললেন আগুন নিভিয়ে কয়লা রেখে দেয়া, সাপ মেরে তার বাচ্চা জীবিত রাখা কোনো জ্ঞানীর কাজ হতে পারে না। তাই এদের বংশ সমূলে উৎপাটন করা অধিক শ্রেয়। বাদশাহর এই কথা শুনে মন্ত্রীর পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও তার প্রশংসা করে বলল, জাঁহাপনা! আপনি যে কথাগুলো বললেন তা একেবারে সত্য ও বাস্তব। তবুও, যদি সে তার পূর্বপুরুষের সংশ্রবে থাকত তাহলে তাদের মতোই একজন ডাকাত হতো। কিন্তু আমার বিশ্বাস সে সৎলোকের সংশ্রবে থেকে একজন আদর্শবান মানুষ হয়ে উঠবে। কারণ সে তো এখনো শিশু এবং রাষ্ট্রদ্রোহীদের কার্যকলাপ তার মধ্যে প্রভাব বিস্তার লাভ করেনি। মন্ত্রীর এই যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে রাজদরবারের আরো কয়েকজন মন্ত্রী তার সাথে সহমত পোষণ করলেন। মন্ত্রীদের কাকুতি মিনতি করার পর বাদশাহ ওই বালককে হত্যা করার থেকে মুক্তি দিলেন এবং বললেন, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। যদিও এতে আমি কোনো মঙ্গল দেখছি না। কারণ কথায় আছে, কোনো শত্রুকে তুচ্ছ ও অসহায় ভাবা সমীচীন নয়। মোটকথা, মন্ত্রী বালককে অতি যতœসহকারে লালন পালন করতে লাগলেন। তাকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য একজন যোগ্য পণ্ডিতকে নিযুক্ত করলেন। যাতে করে কথা বলার সুন্দর ভঙ্গি ও রাজদরবারের আদব-আখলাক শিক্ষা দেয়। কিছু দিন পর বালকটি সব আদব আখলাক শিখে নিলো। একদা মন্ত্রী আনন্দচিত্তে রাজদরবারে তার প্রশংসা করল যে, জ্ঞানীদের প্রভাব তার ওপর বিস্তার লাভ করেছে এবং তার থেকে মূর্খতা ও সর্ব প্রকার অশ্লীলতা দূরীভূত হয়েছে। মন্ত্রী তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেখে বাদশাহ মুচকি হেসে বললেন, বাঘের ছানা যদিও মানব সমাজে লালিত পালিত হয় তবুও পরিণামে সে বাঘই থেকে যায়। এভাবেই দুই বছর কেটে গেল। আর বালকটি এলাকার কিছু বখাটে লোকের সাথে মিশতে লাগল।
এক পর্যায়ে সে তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে একটি ভয়ানক সন্ত্রাসী দল গঠন করল। আর সুযোগ বুঝে আশ্রয়দানকারী মন্ত্রী ও তার দুই পুত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করে মন্ত্রীর অঢেল সম্পত্তি নিয়ে আগের পাহাড়ের চূড়ায় ঘাঁটি গাড়ল এবং বাবার স্থলাভিষিক্ত হলো। বাদশাহ যখন এই মর্মান্তিক ঘটনা শুনলেন তখন আফসোস করতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, লোনা জমিতে কখনো ভালো ফসল উৎপন্ন হয় না, তাই সেখানে বীজ বপন ও পরিচর্চা করা অনর্থক। খারাপদের সাথে দয়া দেখানো, ভালো মানুষের সাথে খারাপি করার মতো।


আরো সংবাদ



premium cement