০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


শরতের সেই মেয়েটি

-

শরতের উজ্জ্বল আকাশ। আকাশে সাদা তুলার মতো মেঘের পাহাড়। ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক উড়ছে। নদীর দু’ধারে, রেললাইনের পাশে বিশাল বনে দুধালো কাশফুলগুলো মৃদু বাতাসে দুলছে। আশ্বিনের সবুজ ধানগুচ্ছগুলো আন্দোলিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সাজ। শরত এসে আসলে প্রকৃতিকে অন্যরকম এক সৌন্দর্যে ভরে দেয়। সাদা শুভ্রতার কাশফুলগুলো এসে শরত আগমনের জানান দেয়। কাশফুল পৃথিবীর গয়না। সেই গয়না পরেই পৃথিবী এত সুন্দর।
আমাদের বাড়ির অদূরে রেললাইনঘেঁষা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠকে কাশফুল ফুটে সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এটি প্রতি বছরের দৃশ্য। ভোরের বাতাসে মাটি ছুঁঁয়ে কাশের আন্দোলিত হওয়ার দৃশ্য একরকম। বিকেলের শান্ত পরিবেশে কাশফুল উপভোগ অন্যরকম। অনুভূতি মধুর। প্রেমিকদের আনাগোনা তখনই বেশি হয়। ইদানীং পাশের গ্রাম থেকে একটি মেয়ে আসে রোজ বিকেলে কাশবনে (বাবার চাকরি বদলির সুবাদে পাশের গ্রামে তাদের সাময়িক নিবাস)। রিকশায় করে আসে। সাথে থাকে ফুলের মতো আরো কয়েক খোকা-খুকি। পুরো বেলা তাদের নিয়ে কাশবনে খেলা করে কাটিয়ে দেয়। ফেরার সময় এতগুলো কাশফুল নিয়ে যায়। সবার হাতে হাতে, খোঁপায় গুঁজে, রিকশা সাজিয়ে বাড়ি ফিরে।
নিত্যদিনের চিত্র এটি। আমার ছোট মিষ্টি বোনটি কাশফুলের দিকে না তাকিয়ে ওর চাঁদ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাশের শুভ্রতায় বিমোহিত না হয়ে তার কাশফুলি পোশাকের উজ্জ্বলতায় মুগ্ধ হয়ে...। সে দ্বিধায় পড়ে যায়। মেয়েটির কারণে কাশফুলের সৌন্দর্য বেড়েছে। না কাশফুলের কারণে মেয়েটির সৌন্দর্য বেড়েছে। এমন মেয়ে কোথাও দেখে নাই। হরিণীর মতো চোখ, উজ্জ্বল ইলিশ মুখ, পিলু বৃক্ষের কাণ্ডসদৃশ মসৃণ হাত-পা-আঙুল। কোনোভাবে নিজেদের মানুষ বানানো যায় কি না! ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যায় সে।
মেয়েটির সাথে কথা বলতে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু সাহস হচ্ছে না। একটি জড়তা এসে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। তবে আজ মেয়েটি নিজেই অবাক করে দেয় তাকে। কাশফুলের শলাকা দিয়ে তৈরি একটি হাতপাখা উপহার দেয় তাকে। আর বলে এই যে ছোট্ট আপু! আমি বানিয়েছি পাখাটি। তোমায় গিফট করলাম। মনটা অনেক বড় হয়ে যায় আমার বোনটির। মুহূর্তেই গড়ে উঠে তাদের মধ্যে সখ্যতা। শরত ও কাশফুল নিয়ে লেখা অনেক কবিতাও আবৃত্তি করে শোনায় সে। কাশফুল ঋতুতে কী অবদান রাখে, কেনইবা কাশের প্রতি তার এত টান সব কিছুই বলতে থাকে। যেন চিরচেনা একজন মানুষ। অন্তরঙ্গ বান্ধবী। ইতোমধ্যেই কাশফুল দিয়ে তার বানানো হাতপাখাসহ নানা সরঞ্জাম পৌঁছে গেছে বনসংলগ্ন কয়েকটি বাড়িতে। কারুকার্য ভরা সরঞ্জাম দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে ফেলেছে। ছোট বোনটি বলল, ওহ হো আপু! তোমার নামটাই তো জানা হলো না! বলল, নাম জাকিয়া। তবে আমি রেখেছি ‘শরত’। তাই এখন সবাই শরত নামেই ডাকে।
আমি কিছুই জানি না। দৌড়ে এসে একদিন বলল আদরের বোনটি ভাইয়া! আমাদের ওই কাশবনে একটি নতুন ফুলের আগমন ঘটেছে। নাম শরত। আমি কিন্তু তোমার জন্য তা ঠিক করে রেখেছি। আরো কত স্তুতি বন্দনা গাইল। কান একেবারে ঝালাপালা। ভালোই লাগছিল। তবু ধমকের সুরে বললাম; গেলি এখান থেকে, গেলি...।
একদিন বিকেলে হঠাৎ দেখি রেল ক্রসিংয়ের সামনে বহু মানুষের জটলা। শোকাবহ একটি পরিবেশ। কৌতূহলী হয়ে কাছে যাই। শুনতে পাই এক বৃদ্ধ মাকে বাঁচাতে গিয়ে শরত নামের একটি মেয়ে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে নাই হয়ে গেছে। ফলে প্রকৃতির এই শুভ মুহূর্তেও শোক নিয়ে বাড়ি ফিরি। ছোট বোনটি এই সংবাদ শুনে কেমন কষ্ট পাবে! ওপারে ভালো থাকুক অদেখা মানুষটি।


আরো সংবাদ



premium cement