০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


একটি তৈলচিত্র ভেসে ওঠে

-

একটি তৈলচিত্র ভেসে ওঠে, উশকোখুশকো অমসৃণ। বাবার চেহারায় একটি জগৎ পড়া যায়। সারা দিনের নিরলস খাটুনিতে ঘর্মাক্ত সারা গা, তেলচিটে পাঞ্জাবির কলার আর পুরনো টুপি পরা! নিতান্তই অযত্নে কানের ওপর উপচে ওঠা তৈলাক্ত চুল, লন্ড্রিহীন জামা, বেখেয়ালে গুঁজে রাখা লুঙ্গির গিট; ঈষৎ উঁচু হয়ে থাকে পেটের ওপর- আর পেটের ভেতর! হতদরিদ্র বাবা সন্তানদের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলতে গিয়ে নীরবে না খেয়ে থাকেন। মাছের কল্লাটা সন্তানের পাতে তুলে দিয়ে নিজে সবার অলক্ষ্যে পান্তা খান, তখন বড় ছেলে বাপের লোকমার সামনে হা করে বসে। বাবা হেসে ফেলেন। ছেলে তার হাতে পান্তা খায়। ছেলে যখন পেঁয়াজে কামড় দিতে ব্যস্ত, বাবা দেখেন র্যাকের ভেতর ছেলের এঁটো প্লেটে মাছের আস্ত মাথাটা তার জন্যই রাখা। বাবা খুব আনন্দে অশ্রুসংযম করেন। ওদিকে টিউবওয়েলপাড়ে মা থালাবাসন ধোয়ার ফাঁকে এ দৃশ্য দেখে নীরবে হেসে ওঠেন।
মধ্যরাতে ঘুমের সময় বাপের ঘুমহীন অবসন্ন দেহ বাজারের পানিশূন্য মাছের মতো কাতরায়। ছেলের হাতখরচ, খাবার ফি, মেসভাড়া। মেয়ের সামনে পরীক্ষা, তার চেয়ে বসা পরীক্ষার ফি আর কেতাব কেনার অসামান্য অঙ্ক! জ্বরের শরীর নিয়ে বাবা বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করেন। রোদে নিঃশ্বাস বন্ধ গরমে মাঠে, ঘাটে, অফিসে বা পানের বরজে ভুুনা গোশতের মতো সেদ্ধ হন। বছরকার দিনে প্রতি দুই ঈদে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল আর শীর্ণ পাঞ্জাবি পরে তিনি ঈদগাহে যান। মূলত, ইচ্ছেমতো পয়সা উড়িয়ে শহরের বুক দাপিয়ে আমরা যেই বিনোদনের পসরায় ডুবে থাকি, নিত্য ভাত গোশত খেয়ে দিন দিন আমরা যেই হাতি সদৃশ বপু নিয়ে গর্ব করে থাকি এবং বাবাদের শেষ বয়সে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে নিক্ষেপ করে আসি- তা মূলত আত্মকে অস্বীকার করার নামান্তর। আমরা আস্ত এক পিতাকে গিলে খেয়ে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হই। এরপর নিজের শেকড় খেয়ে জমিনে দম্ভ করে বেড়াই, অথচ বাস্তবেত আমরা মূলহীন অন্তঃসারশূন্য বুনোগাধা!
বাবা-মা কী চান?
সারা জীবনের সাধ আহলাদ বিসর্জন দেয়ার পর শেষ বয়সে একটু সেবা আর জানাজার চার তকবির! পরিশেষে তিন মুষ্টি মাটি আর দৈনিক নামাজের পর রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা...
একটি তৈলচিত্র সামনে রেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিন দিন নিজেকে বাবার পথে আবিষ্কার করছি। আমি কী করেছি বাবার সাথে? ওই মোড়ে চাদরমুড়ি দিয়ে সেসব আমাকে ধরার জন্য বসে আছে। অচিরেই আমার তৈলচিত্র আমার সন্তানদের সামনে ভেসে উঠবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement