০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রুপালি ইলিশ

-

আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশ পছন্দ করেন না, বাংলাদেশে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার। সবার কাছে ইলিশ খুব প্রিয়। এটি স্বাদে ও গুণে অতুলনীয়। সর্ষে ইলিশ দেখলে আমাদের সবার জিভে পানি এসে আসে যায়। ইলিশ পোলাও, ইলিশ দোপেয়াজা, ইলিশ পাতুরি, ইলিশ ভাজা, ভাপা ইলিশ, স্মোকড ইলিশ, ইলিশের মালাইকারিও লোভনীয় পদ।
ইলিশ একটি চর্বিযুক্ত মাছ। এ মাছে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড (ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড) রয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া গেছে, এ অ্যাসিড মানুষের কোলেস্টোরেল মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। লবণাক্ত জলের মাছ হলেও বড় নদী ও মোহনায় সংযুক্ত খালে বর্ষাকালে ইলিশ পাওয়া যায়। এ সময় ইলিশ ডিম ছাড়তে সমুদ্র থেকে নদী ও মোহনায় সংযুক্ত খালে আসে। ইলিশ সাধারণত চাষ করা যায় না। তবে ইদানীং চাঁদপুরের ইলিশ গবেষণা ইনস্টিটিউটে মিঠা পানির পুকুরে ইলিশের চাষ নিয়ে গবেষণা চলছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, ইলিশ সারা বছর সাগরে থাকে। শুধু ডিম ছাড়তে নদীতে আসে। নদী ও সাগর দুই পদের ইলিশই টর্পেডো আকারের। কিন্তু নদীর ইলিশ একটু খাটো হয়। আর সাগরের ইলিশ হয় সরু ও লম্বা। সেই সাথে নদীর বিশেষ করে পদ্মা ও মেঘনার ইলিশ একটু বেশি উজ্জ্বল। নদীর ইলিশ চকচকে এবং রঙ একটু বেশি রুপালি হয়ে থাকে। সাগরের ইলিশ তুলনামূলক কম উজ্জ্বল। পদ্মা-মেঘনা অববাহিকার ইলিশের আকার পটোলের মতো হয়, অর্থাৎ মাথা আর লেজ সরু; পেট হয় মোটা।
নদীর আর সাগরের ইলিশের স্বাদে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ইলিশ আকারে যত বড় হয়, স্বাদও তত বেশি। সমুদ্র থেকে ইলিশ নদীতে ঢোকার পরে উজানে মানে স্রোতের বিপরীতে যখন চলে, তখন শরীরে চর্বি জমা হয়। এ ফ্যাট বা তেলের জন্যই ইলিশের স্বাদ অনন্য হয়। বর্ষার মাঝামাঝি যখন ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি হয়, সেই সময় নদীতে পাওয়া ইলিশের স্বাদ অতুলনীয়।
দুই দশক আগেও দেশের নদ-নদী ও সমুদ্রে তেমন ইলিশ পাওয়া যেত না। হারিয়ে যেতে বসেছিল। তখন ইলিশের দাম ছিল আকাশছোঁয়া। ইলিশ ছিল বিত্তবানদের ভোজন বিলাসিতা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সঙ্গতি ও সাধ্যের মধ্যে দেশের মানুষ ইলিশ কিনে খেতে পারছেন। মা ইলিশ শিকারে অবরোধসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। ফলে বাজারে গেলে চোখে পড়ে বড় বড় রুপালি ইলিশ।
বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের জনসীমায় ইলিশের প্রাচুর্য দেখে বলা যাচ্ছে। ইলিশের সুদিন আবার ফিরে এসেছে। বিগত বছরগুলোতে যে পরিমাণ ও ওজনের একটি ইলিশের দাম যা ছিল, এ বছর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। তা ছাড়া দেড়-দুই কেজির ওজনের পর্যন্ত ইলিশও এ বছর বাজারে দেখা গেছে, আগে যা ছিল স্বপ্নের মতো। গত বছর গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা নদীতে প্রায় তিন কেজি ওজনের একটি ইলিশ ধরা পড়ে। দুই বছর আগেও চাঁদপুরের কাছে মেঘনায় একই আকারের তিন কেজি ওজনের একটি ইলিশ ধরা পড়েছিল।
ওয়ার্ল্ড ফিশের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের প্রায় ৮৫ শতাংশ উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী ও সাগর থেকে পাঁচ লাখ টন ইলিশ আহরণ করা হয়। ইলিশ উৎপাদনের হিসাবে বরিশাল বিভাগের ভোলার স্থান শীর্ষে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ জেলায় মোট ইলিশ আহরণ হয় এক লাখ ৭০ হাজার টন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বরগুনা। গত অর্থবছরে এ জেলা থেকে আহরিত ইলিশের মোট পরিমাণ ছিল এক লাখ টন।
বরগুনার প্রধান তিনটি নদী বিষখালী, বুড়িশ্বর (পায়রা) ও বলেশ্বর নদী থেকে আহরণ করা হয় ৪৯০০ টন এবং সাগর থেকে ৯১ হাজার টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরগুনা জেলা থেকে আহরিত ইলিশের মোট পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৯৩৮ টন। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার। অন্য দিকে একই অর্থবছরে চাঁদপুর থেকে ইলিশ ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার টন। ইলিশ আহরণের হিসাবে এ জেলার অবস্থান ষষ্ঠ।
ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম মূলত দু’টিÑ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর (ভাদ্র মাস থেকে মধ্য কার্তিক) ও জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি (মধ্য পৌষ থেকে মধ্য ফাল্গুন)। তবে দ্বিতীয় মৌসুমের চেয়ে প্রথম মৌসুমে প্রজনন হার বেশি। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে ইলিশের গতিপথ। বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেলে নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ইলিশের আমদানিও বাড়ে। তাদের মতে, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে যদি ইলিশ ধরা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে প্রতি বছরই ইলিশ মাছ এভাবেই সবার জন্য সহজলভ্য হবে। এ জন্য মাঠ প্রশাসনের সুষ্ঠু তদারকির পাশাপাশি কঠোর নজরদারি করা যেমন দরকার, ঠিক একই সাথে ক্রেতা-বিক্রেতা ও জেলেদের সচেতন হওয়া জরুরি। এতে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশের হারানো গৌরব ফিরতে বেশি সময় লাগবে না।হ
লেখক : ব্যাংকার zrbbbp@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement