০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জমিতে নিষেধাজ্ঞা জারির বিধান

-

কবির চৌধুরী সরকারি চাকুরে থেকে অবসরে গিয়ে একখণ্ড জমি কিনে ছোট্ট আবাসন গড়ে তোলেন। ১২ বছর ভোগদখল করে আসছিলেন। হঠাৎ একদিন শুনলেন একই গ্রামের শফিক জমিটি কিনেছেন। লোকজন নিয়ে দখল করতে আসবেন। তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান জোতদার শফিকের কাছে। শফিক সাফ জানিয়ে দেন, এ জমি তার বাবা কিনেছিলেন। বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে মালিকানা পেয়েছেন। কবির চৌধুরী বুঝতে পারেন শফিকের জমিটিতে শফিকের কোনো বৈধ স্বত্ব নেই। তবু চিন্তিত, শফিক দুষ্ট লোক। বিবাদ করাই স্বভাব। তখন তিনি শরণাপন্ন হন পরিচিত আইনজীবীর কাছে। সমস্যার আইনগত সমাধান দেন ওই আইনজীবী। এ ক্ষেত্রে কবির চৌধুরীর সামনে তিনটি পথ খোলা। শফিক জমি দখল করতে এলে তাকে তাড়িয়ে দেয়া; যার আইনি অধিকার তার রয়েছে; অথবা শফিকের দ্বারা উৎখাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা। বেদখলের পর মামলা করে সাক্ষ্য-প্রমাণে আদালতের সিদ্ধান্ত পক্ষে পেলে ফের জমিটি দখল করা। অথবা শফিকের আস্ফালন স্তব্ধে আদালতে যেতে পারেন। পুরো ঘটনা উপস্থাপন করে নিজের স্বত্ব ও অধিকারের দলিলাদি আদালতে দেখিয়ে তাৎক্ষণিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেন। সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে আদালত ওই জমিতে শফিকের প্রবেশ নিষেধ করে আদেশ দিতে পারেন, যা আইনে ‘ইনজাংশন’ বা ‘নিষেধাজ্ঞা’ নামে পরিচিত। অবশ্য সরকারি উন্নয়নকাজের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষের কথা না শুনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায় না। করলেও এক সপ্তাহের বেশি অনিষ্পন্ন রাখা যায় না।
মামলায় জড়িত কোনো পক্ষের মামলা সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি বিনষ্ট, ধ্বংস বা হস্তান্তর হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে অথবা কোনো ডিক্রি জারির কারণে বেআইনিভাবে বিক্রির উপক্রম হলে অথবা বিবাদি পাওনাদারকে প্রতারিত করতে তার সম্পত্তি অপসারিত বা হস্তান্তরিতের ইচ্ছা প্রকাশ বা হুমকি দিলে আদালত অনুরূপ কাজ রোধে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিতে পারেন। নিষেধাজ্ঞার প্রধানত স্থায়ী ও অস্থায়ী হয়ে থাকে। স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা অনন্তকাল চলতে পারে। মামলার রায় চূড়ান্ত আদেশ হওয়ার পর এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, রহিমের জমির ওপর দিয়ে আজিজ জোর করে রাস্তা বানাতে চান। যেখানে কখনো রাস্তা ছিল না। এ জমি পৈতৃকসূত্রে মালিক রহিম। মামলা করে আদালত থেকে রহিম স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ পেতে পারেন, তার জমির ওপর দিয়ে রাস্তা বানানো যাবে না।
বিচার চলাকালীন বিবাদি যাতে মামলার বিষয়বস্তু হস্তান্তর বা কোনো ধরনের রূপান্তর ঘটাতে না পারেন; সে জন্য মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিবাদিকে এ কাজ থেকে বিরত থাকতে সাময়িকভাবে যে আদেশ দেয়া হয়; তাই অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা। মামলা চলাকালীন কোনো নির্দিষ্ট সময় বা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। একটি সীমিত সময়ের জন্য এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়; তাই একে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বলা হয়। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা পেতে কোনো আলাদা মামলার দরকার পড়ে না। কোনো মামলা করা থাকলে পার্শ্বপ্রতিকার হিসেবে নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত দিয়ে শুনানি করে ইনজাংশন পাওয়া যায়। আদালতের কাছে যদি প্রতীয়মান হয়, মামলার বিষয়বস্তু বিনষ্ট বা ধ্বংসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বা বিবাদি পাওনাদারকে প্রতারণা করতে সম্পত্তি হন্তান্তরের ইচ্ছা বা হুমকি দিয়েছেন; তা হলে আদালত ওই বিতর্কিত বিষয়বস্তু সংরক্ষণে বাদির বা বিবাদির আবেদনক্রমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারেন। মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়তা করতে ওই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। অন্য দিকে শান্তিতে ভোগদখল করার জন্য স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দুই ধরনের হতে পারেÑ মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এবং মামলা চলাকালীন কোনো নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত। আজকাল আদালতে বহুল প্রচলিত ‘স্ট্যাটাসকু’ এক ধরনের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা।
অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বৈশিষ্ট্যগুলো হলোÑ নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করার ক্ষমতা আদালতের সুবিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। এ ক্ষমতা প্রয়োগে আদালতকে পারিপার্শি¦ক অবস্থা বিবেচনায় নিতে হয়। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা একটি নৈতিকতামূলক প্রতিকার। এটি সম্ভাব্য অপূরণীয় ক্ষতি নিবারণমূলক ব্যবস্থা। আদালতে বিবেচনাধীন মামলার ক্ষেত্রে শুধু অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে। প্রার্থিত নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আবেদনকারীর কিছু ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকতে হবে। নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকাকালীন অবশ্যই তা মেনে চলতে হবে। মূলনীতি হলোÑ বাদিকে প্রাথমিকভাবে একটি কেস প্রমাণ করতে হবে। নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনা নামঞ্জুর করলে বাদির অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। বাদির অনুকূলে নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করলে তার বৃহত্তর সুবিধা হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদে মানুষের চলাফেরা ও সমাবেশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। জনস্বার্থে আইনে দিয়ে আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, যেকোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও পুনঃপ্রবেশের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবেÑ যা সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে। অন্য দিকে সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় অংশ নেয়ার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। সংবিধানে এসব কিছু বলা সত্ত্বেও গণউপদ্রব নিবারণকল্পে বা শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ম্যাজিস্ট্রেটকে কিছু নির্দেশ দেয়ার অধিকার দেয়া হয়েছে। এগুলো মানুষের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী নয়, বরং মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে সহায়ক। ম্যাজিস্ট্রেট যখন বুঝিতে পারেন, গণউপদ্রব গুরুতর আকার ধারণ করতে যাচ্ছে; অথবা এমন মারামারি বা দাঙ্গা বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, সে অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধার জারি করিতে পারেন।
অন্য দিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারার মামলা শুধু স্থাবর সম্পত্তিসংক্রান্ত ব্যাপারে বিরোধের ফলে উদ্ভূত শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। স্থাবর সম্পত্তি দখল ও বেদখলের কারণে ১৪৫ ধারার মামলা দায়ের করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। দখল ও বেদখল নিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি এমনকি রক্তারক্তি, খুন, জখমের আশঙ্কা থাকে। এসব থেকে রক্ষা পেতে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৪৫ ধারার মামলা করা যায়। ২০০৭ সালে মাসদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর থেকে ১৪৫ ধারার মামলা দায়ের ও বিচারের কর্মকাণ্ড নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট আদালতের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। তবে ১৪৫ ধারায় মামলা করতে হলে অবৈধভাবে বেদখল হওয়ার দুই মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে, বেদখল হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান থাকতে হবে, শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা থাকতে হবে, মারামারি, ঝগড়া-বিবাদ, রক্তারক্তির আশঙ্কা বিদ্যমান থাকতে হবে, সেই সাথে নিরঙ্কুুশ মালিকানা স্বত্ব বিদ্যমান থাকতে হবে। তবে মনে রাখা উচিত, দীর্ঘ দিন বেদখলে থাকলে এবং সম্পত্তি দখলে না থাকলে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৪৫ ধারার মামলা করা যায় না। সে ক্ষেত্রে ডিক্লারেশন স্যুট করে টাইটল প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। রহিম একটি বড় পুকুরের মালিক। সেখানে ভালো মাছ চাষ হয়। প্রতিবেশীদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে ওই পুকুরের মাছে। একদিন লোকজন নিয়ে জোর করে পুকুরে মাছ ধরতে আসে তারা। রহিম বাধা দিলে তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে চলে যায়। তারা জনবলে বলীয়ান। যেকোনো মুহূর্তে জোর করে পুকুরের মাছ ধরতে পারে। রহিম বাধা দিলে রক্তারক্তি হবে। এ ক্ষেত্রে রহিম ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৪৫ ধারা মতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দিতে পারেন।
কোন অবস্থায় আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন, তা ৩৩ ডিএলআরের ‘মজিবুর রহমান বনাম সিরাজউদ্দিন ব্যাপারী’ মামলায় আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ওই মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘বাদি যদি তার দাবির সপক্ষে ন্যায্য এবং যুক্তিপূর্ণ মামলা প্রমাণ করতে পারেন, তা হলে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ পেতে যথেষ্ট হবেন। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, নালিশি বিষয়বস্তুর সংরক্ষণ। কোনো পক্ষের স্বত্ব আছে কি না; তা নির্ণয় এর উদ্দেশ্য নয়।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
seraj.pramanik@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement