২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পরিবেশবান্ধব সোনালি আঁশ

-

বর্ষার সাথে সাথে গ্রমীণ জনপদে শুরু হয় পাট চাষ। এক সময় দেশে প্রচুর পাট উৎপাদন হতো। কয়েক দশক আগেও সোনালি আঁশ ছিল আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের একমাত্র অর্থকরী ফসল। অথচ ব্যবস্থাপনার অভাব, জুটমিল মালিকদের অজ্ঞতা ও সরকারের উদাসীনতায় বিশ্ববাজারে পাটশিল্পে আমরা অবস্থান ধরে রাখতে পারিনি। বর্তমানে পাট উৎপাদনকারী অন্য দেশগুলোর সাথে তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে আমাদের উৎপাদিত পাটজাত পণ্য। ফলে এ শিল্পে আগের মতো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। স্বাধীনতার পর পাটশিল্প আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। সব ভারী শিল্পের মতো পাটশিল্পও জাতীয়করণ করা হয়। পাটকলগুলোতে সরকার যাদের প্রশাসক নিযুক্ত করে; তাদের বড় বড় মিলকারখানা চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রশাসনিক দুর্বলতার সাথে যোগ হয় দুর্নীতি। ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন পাটচাষি। পাটকলগুলো লোকসান গুনতে থাকে। যে পাট ও পাটকল ছিল একসময় আমাদের গর্ব, ধীরে ধীরে তা বিপর্যয়ে পড়ে। পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে রফতানি আয় কমে যায়।
সমকালে পাটচাষি ও ব্যবসায়ীদের সমস্যা বহুবিধ। দুঃখ-কষ্টের অন্ত নেই। বাংলাদেশ জুটমিলস অ্যাসোসিয়েশনের সূত্রে জানা যায়, পাট কিনতে তাদের ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে সেই সুদের হার ২০ শতাংশ। দেশের অনেক শিল্পে কাঁচামাল আমদানিতে ২ শতাংশ হারেও ঋণ দেয়া হয়। ওই ধরনের সুবিধা পাটশিল্পেও দেয়া যেতে পারে। তা কারো ব্যক্তিস্বার্থে নয়, জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে। উৎপাদন বাড়াতে পাটচাষিকে যেমন প্রণোদনা দেয়া জরুরি; তেমনি পাটশিল্প ও পাট ব্যবসারীদেরও প্রণোদনা না দিলে এ খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে আমাদের পাট রফতানি হতো সাড়ে পাঁচ লাখ টন। এখন আড়াই লাখ টন। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে যেখানে বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল; সেখানে অর্ধেক কমেছে। তবে কাঁচা পাট রফতানি কমলেও পাটজাত পণ্য রফতানি বেড়েছে। এখন দেশে ২৫-৩০টি ছোট পাটকল স্থাপিত হয়েছে। তাতে কয়েক হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক পাটকলে বেতনভাতার অনিয়ম এবং নানা কারণে শ্রুমিকদের বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়। বেশির ভাগ পাটকল শ্রমিকের দুর্দশার শেষ নেই। ১৯৭০ সালে পাটের সুতা রফতানি হতো ১৫ হাজার টন, এখন হচ্ছে ৬ লাখ টন। দেশের ভেতরেও পাটজাত পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রধানত চীন, ভারত, পাকিস্তান, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, ভিয়েতনাম, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, বেলজিয়াম, তিউনিসিয়া, ইরান, এলসালভাদর, স্পেন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, আইভরিকোস্ট, ব্রাজিল, জিবুতি, ইতালি ও তাইওয়ানে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে থাকে। দেশে গড়ে প্রতি বছর পাট উৎপাদন হয় ৬৫-৭০ লাখ বেল। ভারত এরই মধ্যে বাংলাদেশে পাটপণ্যের ওপর অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করায় রফতানি অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। ভারতে বাংলাদেশী পাটের বাজার সঙ্কুচিত হওয়ার পর চীনও আমাদের কাছে থেকে পাটপণ্য কিনতে আগ্রহী হচ্ছে না। যেটুকু আগ্রহী, তাতে আগের তুলনায় দাম অর্ধেক নামিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ৬৫ শতাংশ পাটের সুতা রফতানি হতো তুরস্কে। অর্থনৈতিক মন্দায় সে দেশেও রফতানি কমিয়েছে। এ ছাড়া পাট ব্যবসায়ীদের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, তা এখনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাটব্যবসায়ীদের আর্থিক সঙ্কটও কাটছে না।
২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাধ্যতামূলকভাবে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে আদেশ জারি করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যবহার করা না হলে এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা হবে দ্বিগুণ। আইন হলেও তা কাগজ-কলমে; বাস্তবে কার্যকর নেই। পলিব্যাগের চেয়ে পাটের ব্যাগের দাম বেশি হওয়ায় তা ব্যবহারে আগ্রহ কম। এ দিকে ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৯(ক) ধারা অনুযায়ী, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পলিথিন উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাত, বিক্রি, মজুদ এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পলিব্যাগ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অথচ আমরা এখনো পলিব্যাগের ব্যবহার করছি হরহামেশা। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায়ই এমনটি হচ্ছে।
পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষস্থানীয় হওয়ায় আমরা বিশ্বব্যাপী পাটপণ্যের বহুমাত্রিক ব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরতে পারি। পাটতন্তু দিয়ে আকর্ষণীয় শপিংব্যাগ তৈরি করে সহজে পাশ্চাত্যে সুলভমূল্যে রফতানি করা যায়। গবেষণা সংস্থাগুলো পাটপণ্য ব্যবহারে বৈচিত্র্য আনতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। কিভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাট চাষ করা যায় এবং পাটকাঠি, পাটতন্তু, পাট, পাটপণ্যের বিপণন করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালাতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষ করে তুলতে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন কারখানায় শত বছরের পুরনো মেশিন বদলিয়ে নতুন যন্ত্রপাতি আনতে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। অ্যাগ্রো, জিও, টেকনিক্যাল ও হোম টেক্সটাইলে পাটতন্তুর সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার বাড়াতে হবে। সরকার, মিল মালিক ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সাথে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে এ খাতের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে নানামুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
দেশের ভেতরে পাটজাত পণ্যের বাজার যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে এর রফতানিও। ফলে কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, রফতানিকারক, ভোক্তাসহ চার কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে পাটশিল্পে। পাট উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে যেহেতু শ্রমিকের মূল্য কম এবং আবহাওয়া ও মাটি পাট চাষে অত্যন্ত উপযোগী, তাই সহজে এ খাতে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সময়ের দাবি। সরকার এ ক্ষেত্রে যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারে। পাটশিল্পের ভবিষ্যৎ এখনো উজ্জ্বল। এতে দেশের বেকারত্বের হার যেমন কমবে, তেমনি শিগগিরই আমরা ফিরে পাবো হারানো পরিবেশবান্ধব সোনালি আঁশের সুদিন। হ
লেখক : প্রাবন্ধিক


আরো সংবাদ



premium cement