২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বইমেলা : বইয়ের প্রাঙ্গন হয়ে ই-বুকের জগতে

- ছবি : ডয়চে ভেলে

পাঁচ দশক আগে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের বটতলায় এক টুকরো চটের উপর শুরু হয়েছিল বইমেলা। কলেবর বেড়ে মেলার বিস্তৃতি এখন বাংলা একাডেমি ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত।

১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় এক টুকরো চটের উপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে শুরু করেছিলেন বইমেলা। এই ৩২টি বই ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহার নিজের প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা বই।

সেই বইমেলার কলেবর বেড়ে এখন বাংলা একাডেমি ছেড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিস্তৃত হয়েছে। সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায় ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠান ৯৩৭টি স্টল স্থাপন করেছে। শুধু মেলার আকারের পরিবর্তন হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে এখানেও। কাগজের বই থেকে এখন আগ্রহ বাড়ছে ই-বুক বা ডিজিটাল বুকে। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে অডিও বুকেরও। নামকরা প্রকাশকেরাও ই-বুকে আগ্রহী হচ্ছেন।

গত পহেলা ফেব্রুয়ারি বইমেলার উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু কাগজের বই প্রকাশ না করে ডিজিটাল মাধ্যমেও বই প্রকাশ করার জন্য প্রকাশকদের তাগিদ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আপনারা ডিজিটাল প্রকাশক হলে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও পৌঁছাতে পারবেন। মনমানসিকতা পরিবর্তন করে আধুনিক প্রযুক্তিটাও রপ্ত করতে হবে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারলে আমরা এগিয়ে যাব।’

প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল মাধ্যমে বই প্রকাশের কথা বললেও বাংলা একাডেমি এখনো সে পথে হাঁটতে পারেনি। ডিজিটাল মাধ্যমে বই প্রকাশের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বাংলা একাডেমি।

বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা এখনো এই ধরনের উদ্যোগ নিতে পারিনি। তবে ভবিষ্যতে চেষ্টা করবো। অবশ্য বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ডিজিটাল বই প্রকাশ করছে। সরকারিভাবে আমাদের শুরু করতে হবে।’

বইমেলার যাত্রা :
বইমেলার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৭২ সালে চিত্তরঞ্জন সাহার শুরু করা বইমেলা ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি মহান একুশে মেলা উপলক্ষে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমির প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং তাদের দেখাদেখি আরো কেউ কেউ বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি সে বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে।

১৯৭৫ সালে একাডেমি মাঠের কিছু জায়গা চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। সেখানে প্রকাশকরা নিজেদের মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এভাবে চলতে চলতে ১৯৮৩ সালে মেলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাদ দেয়া হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে এই মেলার নতুন নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। এরপর পেছনে ফিরতে হয়নি। দিন দিন বেড়েছে মেলার কলেবর। বেড়েছে বিক্রিও।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায়, ডিজিটাল দুনিয়ায় :
প্রকাশকেরা গত কয়েক বছর ধরেই ডিজিটাল ভার্সনের বই বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ভিন্নধারার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘কাহিনীক লিমিটেড’ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান চত্ত্বরের ৩৯৭ নম্বর স্টলে আগত সাহিত্যপ্রেমীদের ‘কাহিনীক’ অ্যাপের মাধ্যমে সাহিত্যরস আস্বাদনের সুযোগ করে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ধ্রূপদ ও সমকালীন বাংলা সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার হিসেবে শতাধিক অডিওবুক নিয়ে সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে কাহিনীক। দেশের প্রথম সারির বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ভালোমানের বই নিয়ে তারা অডিওভার্সন তৈরি করেছে। শুধু কাহিনীক নয়, কাব্যিক ও শুনবই নামে আরো দু’টি প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেল বাংলা একাডেমি চত্ত্বরে।

স্টলে থাকা কাব্যিকের ব্রান্ড অ্যাক্সিকিউটিভ সুমাইয়া জামান মিম বলেন, ‘২০২২ সালের শেষের দিকে যাত্রা শুরু হয় কাব্যিক অডিওবুক প্লার্টফর্মের। ইতোমধ্যে এই প্লাটফর্মে বাড়ছে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা। আড়াই হাজারের বেশি বই ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে এই প্লার্টফর্মে। হরর, থ্রিলার, রোমান্স, অ্যাডভেঞ্চার, মোটিভেশন, ক্লাসিক, রিলিজিয়াস, বায়োগ্রাফি, কবিতা, বিশেষ শিশুতোষ কন্টেন্টসহ কাব্যিকের রয়েছে নিজস্ব অনেক কন্টেন্ট। ২০২৩ সালেও অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ছিলো কাব্যিকের স্টল। এবারো আমাদের স্টলে বইপ্রেমীরা এসে ভিড় করছেন আর অভিজ্ঞতা নিচ্ছেন দেশের সর্ববৃহৎ এই অডিও লাইব্রেরির।’

শুনবই-এর স্টলে দায়িত্বে থাকা সিমু আক্তার বলেন, ‘আমাদের এই উদ্যোগটা মূলত সব শ্রেশির মানুষের জন্য। মানুষ এখন অনেক বেশি ডিজিটাল মাধ্যমে সময় কাটায়। অনেকে মোবাইলে পড়তে চান না। তাদের জন্য আমাদের অডিও বুকের ব্যবস্থা। শিশুরা যেমন অডিও বুক শুনতে পারে, তেমনি অনেক বয়স্ক ব্যক্তি আছেন যারা পড়তে পারেন না, তাদের জন্যই আমাদের এই আয়োজন। দিন দিন মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।’

এখন পর্যন্ত ৩০০ বই নিজেদের প্লাটফর্মে এনেছেন বলে জানালেন স্টলে থাকা আরেক কর্মী জান্নাতুল ফেরদৌস।

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অনন্যা প্রকাশনী, কাকলি, অনুপমসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনার বইয়ের অডিওভার্সন পাওয়া যাচ্ছে কাহিনীক প্রকাশনীতে।

অনুপম প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মিলন নাথ বলেন, ‘পাঠক, বই ও সাহিত্যপ্রেমীদের তরুণ অংশ এখন ডিজিটাল ডিভাইস নির্ভর। সেই প্রবণতা বিবেচনায় রেখেই অডিও ভার্সনে পাঠক-শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার অবিরাম চেষ্টা চলছে। আশা করছি, এক্ষেত্রে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাবে আমাদের বইয়ের প্রকাশ ও প্রচারণা। প্রযুক্তি হচ্ছে এ সরকারের ভিশন। এই ভিশনের সাথে আমরাও আছি।’

সবচেয়ে বেশি বই রয়েছে রকমারি ই-বুকে। রকমারির ই-বুকের স্টল বাংলা একাডেমি চত্ত্বরে।

স্টলে থাকা শিমুল মোল্লা বলেন, ‘আমাদের ই-বুকে ৭ হাজারেরও বেশি বই রয়েছে। কিছু বই ফ্রি পড়া যায়। আর কিছু বই টাকা দিয়ে পড়তে হয়। সব ধরনের লেখকের বই আছে আমাদের অনলাইনে। গত এক বছরে আমরা ৪ হাজারেরও বেশি বই অনলাইনে যুক্ত করতে পেরেছি। ভবিষ্যতে আরো সমৃদ্ধ হবে।’

অনন্যা প্রকাশনীর মনিরুল হক বলেন, ‘বইমেলার উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ডিজিটাল প্রকাশক হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল প্রকাশনার এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন অনেক প্রকাশক। ইতোমধ্যে অনেকে বইয়ের অডিও, ভিডিও ফরম্যাট করার চেষ্টা করছেন। ফলে আমরাও প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবো। অডিও ও ই-বইয়ের মধ্য দিয়ে ব্যবসারও অগ্রগতি হবে।’

সূত্র : ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement