২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সবার আগে দেখতে হবে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো Ñকেট ব্ল্যানচেট

ভিন দেশ
-

কেট ব্ল্যানচেট। জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের শুভেচ্ছা দূত তিনি। অভিনয় বা অভিনয় শিল্পী হিসেবে পরিচয় থাকলেও সামাজিক নানা ক্ষেত্রেও তার বিশেষ অবদান রয়েছে। ব্ল্যানচেট ২০১৩ সালে স্কাই নিউজ নামক একটি সংবাদ চ্যানেলে নারীবাদ ও রাজনীতি সম্পর্কে মূল্যবান বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি দেখান যে, সারা বিশ্বে রক্ষণশীলতার প্রতিযোগিতা রয়ে যাচ্ছে, যা গোটা বিশ্বের নারী জাতির সামাজিক ভূমিকাকে ত্রাসের মধ্যে নিক্ষেপ করছে। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে তিনি খুবই সচেতন। হলিউডে নারীরা যে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে তা নিয়েও তিনি সচেতন ছিলেন। নানা মাধ্যমে তিনি এ সংক্রান্ত বক্তব্যও দেন। তার এ সংক্রান্ত নানা কাজের সফলতা দেখে মে ২০১৬ তে ইউনাইডে নেশনস হাইকমিশনার রিফিউজি নামক একটি প্রতিষ্ঠান ব্ল্যানচেটকে গুডউইন অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ঘোষণা করে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি সারা বিশ্বে রিফিউজি বা উদ্বাস্তু সমস্যা ও তার সমাধানের উপায়ের ওপর বিশেষ আলোকপাত করেন। পাশাপাশি জনসাধারণের মধ্যে এ সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতেও অনেক দূর এগিয়ে যান। মাস কয়েক আগে বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন জাতিসঙ্ঘের এ শুভেচ্ছা দূত। কিছু দিন আগে সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি ভাষণ দেন নিরাপত্তা পরিষদে। তিনি বলেন, আমি নিজের চোখে সেখানে গিয়ে যা দেখেছি এবং শুনেছি, তাই বলতে এসেছি দুঃখভারক্রান্ত হৃদয় নিয়ে। মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীদের মুখে নির্যাতনের যে নির্মম কাহিনী আমি শুনেছি, তাতেই আমি যেন নির্বাক। এবার ভাবুন, তা বাস্তবে দেখলে স্বাভাবিক একজন মানুষের মনের কী অবস্থা হবে। মোট কথা, কোনোভাবেই আমার পক্ষে তার ভয়াবহতার চিত্র বা ব্যপ্তি প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কেট ব্ল্যানচেট বলেন, মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে পালিয়ে আসা কিছু নারীর মুখে শুনেছি, মিয়ানমারের দোসররা অগণিত ঘরে আগুন দিয়েছে, গৃহে থাকা মানুষদের সেখানে আটকে রেখে। স্বজন বা প্রাণপ্রিয় মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাদেরই সামনে। এ নির্মাম দৃশ্য দেখে তারা যেমন ভয় পেয়েছে, তেমনি পাগলের মতো এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এসব ছাড়া নারীদের ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে অগণিত। বাবা-মায়ের সামনে তাদের সন্তানকে আগুনে ছুড়ে মারারও ঘটনা ঘটেছে প্রচুর।
অবশ্য এবারই প্রথম নয়, মিয়ানমার থেকে গণহারে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়ার ঘটনা। তিনি আরো বলেন, প্রায় ৪০ বছরে দেশটি থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা তাদের ভিটেমাটি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। আজ সেই দেশটির যতজন রোহিঙ্গা রয়েছে, তারচেয়ে অনেক বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে দেশটির বাইরে। ১৯৭৮ সালে হত্যা আর নির্যাতনের তোপের মুখে পড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা। ফের গণনির্যাতনের কারণে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে ১৯৯২ সালে। এভাবে বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার সইছে। এমনো রোহিঙ্গা শরণার্থী নারী আছে, যারা এভাবে কয়েকবার বিতারিত হয়েছে। তাদের বয়স এখন ৮০ থেকে ৯০ বছর। তাদের একটাই আশা। তা হলো, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে ভালোভাবে নিজ দেশে বসবাস করতে পারে। একদিন উজ্জ্বল হবে তাদের আগামী দিনগুলো। তবে তিনি বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তাদের এ দুর্দিনে বাংলাদেশের মানুষ যদি দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে এগিয়ে না আসতো, তবে তাদের কষ্ট আরো বেড়ে যেত। এগিয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থাও। তবে অগ্রগতি আসতে সময় একটু বেশি নিচ্ছে। কারণ বিষয়টি জটিল করে রেখেছে মিয়ানমার। এ জন্য দোষীদের শাস্তি পাওয়া দরকার। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দৈনন্দিন চাহিদার খুব সামান্যই পূরণ হচ্ছে। গোসল, খাওয়া, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি সঙ্কট প্রকট। নানা সমস্যায় পড়ে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতাও কমবেশি দেখা দিয়েছে, যা সামাজিক সমস্যা বাড়াচ্ছে। মিয়ানমার সরকার তাদের দেশের কিছু জায়গা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে এমন অবস্থা করেছে, যাতে ইচ্ছা হলেও শরণার্থীরা তাদের নিজ আবাসভূমিতে ফিরে যেতে না চায়। কারণ জমিজমাসহ অন্যান্য সম্পদ-সম্পত্তিও লুটপাট হয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে কেট ব্ল্যানচেট বলেছেন, আমাদের হাত-পা গুটিয়ে রাখলে চলবে না। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কূটনৈতিক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সহজ করতে হবে। আরো দেখতে হবে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো। মিয়ানমারকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
ব্ল্যানচেট এক সময়ে কাজ করতেন সম্পত্তি উন্নয়নকারী ও শিক্ষক হিসেবে। তার বাবা টেক্সাসের স্থায়ী বাসিন্দা। তার ১০ বছর বয়সে বাবা মারা যান হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। তখন তাকে মানুষ করার দায়িত্ব চাপে তার মায়ের ওপর। একটু বড় হয়ে ব্ল্যানচেট নিজেকে পরিচয় দেন একজন বহির্গামী হিসেবে। তবে তিনি বাইরের জগতে অভ্যস্ত শিশুকাল থেকে। মেলবোর্নে প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করে আইভেনহো গার্লস গ্রামার স্কুল অতিক্রম করে ম্যাথডিস্ট লেডিস কলেজ শেষ করেন। সেখান থেকে কলার নৈপুণ্য অর্জন করেন। টিনএজ বয়সের শেষের দিকে ভিক্টোরিয়াতে তিনি নাসিক হোমে সেবাদান করেন। পরে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও শিল্পকলা অধ্যয়ন শুরু করেন। তবে বিদেশ ভ্রমণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসতে হয়।
যখন তিনি মিসরে, তখন মিসরের একটি ছবিতে (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক) অভিনয় করেন। অভিনয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করেন আর্থিক প্রয়োজনে। পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়া থেকে যখন ফেরত আসেন তখন আবার চলে যান সিডনিতে এবং অভিনয় জীবন গড়ে তোলার জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডেমোক্র্যাটিভ আর্ট বা নিডাতে তালিকাভুক্ত হন। শিল্পকলায় ব্যাচেলর ডিগ্রিও অর্জন করেন। অস্ট্রেলিয়ান ফিল্ম ইনস্টিটিউট এবং অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি অব সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন আর্টস নামক প্রতিষ্ঠান দুটোতে পৃষ্ঠপোষক ও দূত। সিডনি ফিল্ম ফেস্টিভালেরও পৃষ্ঠপোষক। ২০০৫ সালে প্রক্টার অ্যান্ড গ্রাম্বল নামক বিলমিন পণ্যের প্রতিষ্ঠানেরও মুখপাত্র ছিলেন ব্ল্যানচেট। ২০০৬ সালে একটি জলবায়ু প্রকল্পে যোগ দেন। এর লক্ষ্য হলো বিশ্বের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে কাজ করা। ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ান কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের অ্যাম্বাসেডর হন। ২০১২ তে একই প্রতিষ্ঠানে আজীবন সদস্য হন। এর কারণ ছিলÑ পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে তার বিশাল অবদানের স্বীকৃতি। পরবর্তীকালে গ্রিন কারপেট চ্যালেঞ্জ নামক একটি অভিযানে যোগ দেন। দেখা যাচ্ছে কেট ব্ল্যানচেট মানব কল্যাণে আসেÑ এমন নানা বিষয়ের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থেকে বিশ্ববাসীর পাশে থাকছেন। এসব কাজে তিনি অনেকের কাছ থেকে শুধু সমর্থনই পাননি, পেয়েছেন সহযোগিতাও।
কেট ব্ল্যানচেটের জন্ম অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া নামক জায়গার আইভেনহো নামক স্থানে ১৯৬৯ সালের ১৪ মে। তার পুরা নাম ব্যাথেবাইন এলিসা ব্ল্যানচেট। থাকেন ইংল্যান্ডের পূর্ণ সাসেক্সের ক্রোবোরোগ নামক স্থানে। আর তিনি জনকল্যাণমূলক এসব কাজ শুরু করেন ১৯৯২ সাল থেকে।


আরো সংবাদ



premium cement